Skip to content

কার্তুজ – পর্ব দুই । জয়ন্ত সেন

যখন জ্ঞান এলো তখন আমি হাসপাতালে, কিভাবে কখন এসেছি জানা নেই, তবে ঘোরটা তখনও কাটেনি, কানের কাছে তখনও গুলি-বর্ষণের শব্দ হচ্ছে, বেশি কিছু মনে পড়ছেনা, শুধু কয়েক ফুট দূরে ফেলা গ্রানাইড-এর বিস্ফোরণে আমি ছিটকে পড়েছিলাম সেটা জানি |
বোধয় আমার জ্ঞান ফেরার কথা আগেই বলা হয়েছে ডক্টর-কে |
– গুড মর্নিং ক্যাপ্টেন, আপনাকে বাঁচানো এতো সহজ ছিলোনা, বাট আই’ম গ্ল্যাড আপনি একইরকম ভাবে কো-অরডিনেট করেছেন, প্রাণ ছাড়েননি |
-আমি কতদিন ধরে এখানে আছি ?
-উনিশ দিন ধরে, আর আপনার স্ত্রী বাইরে বসে আছে | আপনার হুঁশ এসেছে, বলা হয়েছে |
এরইমধ্যে রুমে আরেকজন ঢোকে | আমি চিনি তাকে | মিঃ ভিক্টর | ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স অফিসার | সাধারণত ওনার দিল্লীতেই ওঠা-বসা |
– কথা বলতে পারবেন ?
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলে মিঃ ভিক্টর শুরু করেন | – বিগ লস, দে কিল্ড আওয়ার টু সোল্জার্স এন্ড এজেন্ট সাব্বির, দে স্টোল আওয়ার অল আর্মস |”
জাহাঙ্গীর-কে আটকাতে ঠিক হয়েছিলো প্যারালাল আরেকটা মিলিট্ন দল তৈরী করা হবে | এ-সময়ে বিরোধী আরেক দলনেতা ইসমাইলের কাছেও বেশ ভালো-রকম একটা মিলিটনস আর সিভিলিয়ান সাপোর্ট ছিলো | কাশ্মীরের পিসফুল পলিটিকাল সল্যুশনের স্বার্থে ইসমাইলকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে সির্ধান্ত হয়েছিলো | কিন্তু ইসমাইলের কাছে আর্মস-সোর্স কম জাহাঙ্গীরের তুলনায় | র-এজেন্ট সাব্বির ইসমাইলের সাথে ডিল করেছিলো, ইসমাইলকে আর্মস দেওয়া হবে | এজেন্ট সাব্বির, ইন্দ্র সমেত আরো দুজন জওয়ান একটা ট্রাকে আর্মস নিয়ে ডেলিভার করতে যাচ্ছিলো ইসমাইলের দেওয়া ঠিকানায় | কিন্তু মাঝপথেই ওদের ওপর হামলা হয় |

-স্যার ! আমি করবো, অফ দি রেকর্ড |
ইন্দ্রর গম্ভীরভাবে কথাটা শোনার পর ভিক্টর মনে মনে খুশিই হয়েছিলো | ভিক্টর বুঝেইছিলো ওদের মধ্যেই কেউ লিক আছে, যার ইনফর্মেশনেই আর্মস ডিলিং-এর দিন ও সময় জাহাঙ্গীরের লোকেরা জানতে পেরেছিলো | এখানে ইন্দ্রজিৎ র-কে রিপ্রেজেন্ট করলে কেউ ওকে টার্গেট করবে না | কিন্তু প্ল্যান চেঞ্জ হোলো | ইসমাইলের সাথে চুক্তি বানচাল হওয়াতে ইন্ডিয়ান কন্সপিরেসি-তে ঠিক হোলো জাহাঙ্গীরের দলকে দু-ভাগে ভাগ করার ফন্দি বানানো হবে | যুবেন আনসারী হোলো নতুন টার্গেট | যুবেন কাশ্মীর মিলিটনস ফোর্সের সেকেন্ড কমান্ডার, জাহাঙ্গীরের নামে সমস্ত বিল ছেঁড়ার কারণে যুবেনের রেকর্ড সবসময় ক্লিন থাকতো | কিন্তু সবাই জানে ভেতরে ভেতরে যুবেন মিলিটনসদের সাথে মিলে আছে | আর সেজন্যে ইন্দ্রজিৎ সেনকে সিক্রেটলি ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ফোর্স র-তে সামিল করা হোলো |

-মুস্তাফা সিরাজ, জাহাঙ্গীর-এর বেস্ট ওয়েপন | সার্প-শুটার | একসময় স্টেট-লেভেলে শুটিং চ্যাম্পিয়ন ছিলো | কিন্তু জানোতো আমাদের দেশে এধরণের গেমসকে এনক্যারেজ করা হয়না | তাই মিলিটনসদের সাথে যোগ দিয়েছে |”
সন্ধ্যেবেলায় দু-পেগ উইস্কি গলায় ঢেলে মিঃ মানিক গল্প জোরে | উনিশ্য একান্নব্বইয়ে শ্রী-লঙ্কায় সিভিল ওয়ারের সময় ভারত থেকে যখন আর্মি এলোকেট করা হয়েছিলো তখন র-থেকে মানিকবাবু দীর্ঘদিন শ্রী-লঙ্কায় ছিলেন | কোনো এক পরিস্থিতিতে গুলিও খেয়েছিলেন, আজও উনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন | শ্রী-লঙ্কার সেসময়ের পরিস্থিতি আর আজকের কাশ্মীরের পরিস্থিতি একইরকম,তাই মিঃ মানিককে কাশ্মীরে পাঠানো হয়েছিলো | মানিকবাবুর ইনফরমেশন চ্যানেল সোর্স দারুন, কাশ্মীরের আনাচে-কানাচের খবর ওনার কাছে সবসময় আপডেটেড | সংসার ধর্ম করেনি কোনোদিন, হয়তো চাকরির জন্য | তবে সে নিয়ে নালিশ না করলেও “এদিকে দিল্লী-তে বসে মিনিস্ট্রার বলেছে এই হোগা, ওই হোগা, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা বলে খালাস আর আমাদের মতো চুনো-পুঁটি দের সব সামলাতে হয় | আরে তোরা এতো কিছু করবিতো এখানে এসে এখানে বসে করনা | আর সবকিছু শেষ হওয়ার পর আমাদের কেউ পোছেও না |” বলে ক্ষোভ জানাতো | কথায় কথায় কোথা থেকে কার খবর জানতে পারা যায় মানিকবাবুর কাছ থেকে ইন্দ্র জানতে পারে | ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী ইন্দ্রকে মিঃ মানিককেই রিপোর্ট করার কথা ছিলো, কিন্তু এখন ইন্দ্র আর্মির নয় র-এর হয়ে কাজ করে, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভালো খারাপ বুঝে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে | তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে শ্রীনগরের ডাউন-টাউন মার্কেটের এক বাড়িতে যুবেন আনসারীর সাথে ইন্দ্র দেখা করে |

-কি চাও ?”
-পিসফুল একটা সল্যুশন |
-কি অফার ?
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্দ্র বলে “-আমার কাছে কোনো অফার নেই, সবকিছু তোমার কাছেই আছে | আমি রাস্তাটা দেখাতে পারি |
আনসারীর বড়ো বড়ো ভুরুতে ঢাকা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে | ইন্দ্র আবার শুরু করে, – জাহাঙ্গীর কেনো, তুমিও দাঁড়াতে পারো ইলেক্শনে | জাহাঙ্গীরের খবর তুমি দেবে, আর জাহাঙ্গীর চলে গেলে ইটস অল ইওরস | পরিবর্তে গভর্মেন্ট তোমায় সাপোর্ট করবে |
-গভর্মেন্ট কি করছে দেখতেই পাচ্ছি | নির্দোষ কলেজ স্টুডেন্ট দের মামা-টু কয়েদখানায় ভোরে ভোরে তাদের ইন্টারোগেশনের নামে টর্চার করা হচ্ছে | রোজ কারফিউ লাগছে, সাধারণ মানুষদের-কে হ্যারাস করা হচ্ছে | মিলিটনস-এর নাম দিয়ে এনকাউন্টার করছে | তোমরা বুঝতে পারছোনা, লোক জাহাঙ্গীরের দলে নিজে থেকেই যোগ দিচ্ছে |
-তুমি বুঝতে পারছোনা | কাশ্মীর ভারত থেকে স্বাধীনতা নয় পাকিস্তান থেকে গোলামী চাইছে | আর তোমরা কি বাকি রেখেছো ! ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতিয়ার ধরিয়েছো, স্বাধীনতার লড়াইয়ের নামে তোমরা মার্ডারার তৈরী করছো | কাশ্মীর স্বাধীন হলেও বা-কি, একটা জঙ্গী দেশ নামেই পরিচিতি পাবে | পাকিস্তান ছাড়া কোনো দেশ সমঝোতা করবেনা, কি করে চালাবে তখন ! তুমি যদি সত্যি চাও কাশ্মীরের উন্নতি তাহলে তুমি পলিটিক্স-এর মাধ্যমেই দিতে পারো | এভাবে খুন-খারাপি করে নয় |
-তুমি আসতে পারো এখন |
-তোমার সম্মতি দেওয়া ছাড়া এখন কোনো উপায় নেই তোমার কাছে | এই মিটিং-টার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সির টার্গেট হয়ে গেলে তুমি, শুধু তাই নয় জাহাঙ্গীর অবশ্যই জানতে চাইবে র-এর সাথে তোমার কি নেগোসিয়েশন হয়েছে | ইউ নো অল থিংস, এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা | দু-তরফেই তুমি ইন্টারোগেট হবে |
আনসারী ঝাঁঝিয়ে ওঠে “- কিভাবে ? এই মিটিংটার কথা কেউ জানে না “|
স্নাইপার স্পেসালিস্ট ইন্দ্রজিৎ সেন চুপ করে থাকে কিছুক্ষন, দূর থেকে টার্গেটের মুভ ফলো করে অ্যাকশন প্রেডিক্ট করা ওর অভ্যেস হয়েগেছে | তারপর সুযোগ বুঝে হিট করে | ইন্দ্র জানতো মানিক ইস দি লিক | দীর্ঘদিন কাশ্মীরে থেকে, অসাধারন এক ইনফর্মার চ্যানেল সোর্স থাকা সত্যেও মানিক জাহাঙ্গীরের খবর দিতে পাচ্ছিলোনা | ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবার জওয়ানরা ট্রাপে পড়েছে | খুরশিদের মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে বলেছিলো ‘আমায় ছেড়ে দাও, আগে ঘর পরিষ্কার করো |’ ইন্দ্র মুখে চিলতে হাসি এনে বলে “-তুমি সেটা জানো কারণ, এই মিটিংটা মানিক-কে না জানিয়েই হয়েছে | তারমানে এইনয় যে র-জানে না |’

বেডরুমের কোনে রাখা ছোট্ট টেবিলে মাথা রেখে কখন ইন্দ্রর চোখ লেগে গেছে খেয়াল হয়নি | আজ সারাদিন খুব ব্যাস্ততার মধ্যে দিন কেটেছে | সৈয়দ-কে আড্ডাপটেশনের সব ফর্মালিটি আজকে শেষ হয়েছে | সৈয়দকে নতুন স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে | অর্পিতা, অনন্যা, সৈয়দ-কে নিয়ে আজ ইন্দ্র সিনেমা দেখেছে, শপিং করেছে, বাড়ি ফিরে অনন্যার হামাগরি রেকর্ড করেছে, খেলনা বন্দুক নিয়ে সৈয়দের সাথে ডার্ট-বোর্ডে শুটিং কম্পিটিশন করেছে, অর্পিতা ইন্দ্রকে সৈয়দের আম্মি-আব্বু নামে ডাকায় মন খুলে হেসেছে |
আধখোলা ডাইরিটা বন্ধ করে দেয়, কিছু কথা শুধু মনের মধ্যেই থাকুক | বিশেষ করে মানিকের রিভেঞ্জ নেওয়ার গল্প | সেদিন আনসারীর সাথে কথা বলার পর ইন্দ্র ভিক্টরকে ফোন করে | জাহাঙ্গীরের লোকেশন আনসারী বলেছিলো | সেদিন রাতেই মানিকের সাথে দেখা করে | আধ-গ্লাস উইস্কি হাতে নিয়ে মানিক আফসোসের সাথে বলেছিলো ‘ ওয়েলডান মিঃ ইন্দ্রজিৎ সেন | এতবড়ো একটা কন্সপিরেসি সমাধান করেদিলে |’
ইন্দ্র জিজ্ঞেস করে মানিকের বিট্রেটের কারণ | মানিক খুবই শান্ত গলায় বলতে শুরু করে ” শ্রী-লঙ্কায় থাকা কালীন আমি এল-টি-এফের হাতে ধরা পড়ি | আমাকে ইন্টারোগেট করে ইন্ডিয়ান কনস্পিরেসির কথা লিক করার জন্য | তুমি জানো ইন্দ্র জঙ্গিদের ইন্টারোগেশন কেমন হয় ! ওরা নোখ উপরে ফেলে, হাতের কুনুই কেটে দেয়, পায়ের মালাইচাকি কেটে দেয়, গোড়ালি কেটে দেয় যাতে মানুষ সরীসৃপের মতো থেকে যায় | কিন্তু আমি হার মানিনি | বলিনি ওদের কিছুই | তারপর জানতে পারি আমার জন্য কোনো সমঝোতা হয়নি,
না কোনোদিন রেসকিউ টীম পাঠানো হোলো |
– ইউ নো দি কন্ডিশন, যেদিন তুমি দেশের জন্য ইন্টেলিজেন্সে এসেছিলে তার প্রথম মুহূর্ত থেকে |
ইন্দ্রর কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে মানিক “-তোমার কাছে বলা সোজা কারণ তুমি আমার মতো জীবন কাটাওনি | ওরা আমায় নপুংশক বানিয়ে দিয়েছে | তোমার বউ তোমায় নগ্ন হয়ে তাপ দেয়,তুমি সে ভোগ করতে পারো তুমি তোমার ফ্যামিলিকে বংশ দিতে পারো, তোমার কাছে বলা সোজা |
ইন্দ্র বেশ খানিক্ষন চুপ থাকার পরে সিক্স চেম্বারের কোল্ট রিভলবারটা বারকরে | লোডেড রিভলবারের পাঁচটা বুলেট বার করে রিভলবারটা মানিকের হাতে দেয় | -তোমার জন্য আমাদের অনেক জওয়ান মারা গেছে, তোমার ব্যাকস্টেব এক্সপোস হয়েগেছে, তবুও তুমি এরেস্ট হওয়ার আগে আমি চাইছি এই সির্ধান্ত-টা তুমি তোমার জন্য নাও |
ইন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলো |

মন্তব্য করুন