Skip to content

কাজল

  • by

কাজল

কাজলের খুব মজা। বাবা-মা বাড়িতে নেই। মাসির ওখানে বেড়াতে গেছে। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে, মা জিজ্ঞেস করেছিল,…. ‘তা হ্যাঁ-রে ! ফিরতে ফিরতে কিন্তু সন্ধে হয়ে যাবে। একা থাকতে পারবি তো ?’ কাজল মাথা হেলিয়েছে। পারবে।

সত্যিই তো ! না পারার কি আছে। কাজল ভাবলো, ও কি এখনও ছোট আছে ? ক্লাস এইটে পড়ে। পাশের বাড়ির রুমকি তো ওর থেকেও ছোট। কাকু, কাকিমা দুজনেই চাকরি করেন। ফিরতে দেরি হয়। ওতো স্কুল থেকে ফিরে একাই থাকে। তাহলে কাজল পারবে না কেনো ?

আজ রবিবার, স্কুল ছুটি। এমনিতে কাজল ছুটির দিন মায়ের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে টুকিটাকি কাজ করে। আজ সেটা করতে হয় নি। মা, বাবা সকালেই বেরিয়ে গেছে। মানদা মাসি এসে ঘর ঝারপোছ, বাসন মেজে, সকালের রান্না করে দিয়ে গেছিলো। মাছ, ভাত আর বেগুন ভাজা।

ঠিক সময়ে স্নান করে, একটা থালায় ভাত, বেগুন ভাজা আর মাছের ঝোল নিয়ে কাজল খেয়েছে। স্কুল থাকলে টিফিনের সময়ে ও বন্ধুদের সাথে একসাথে খায়। ছুটির দিন মা-বাবার সাথে। খাবার সময় একটু মন খারাপ হলেও, একা থাকার আনন্দে দুঃখটা আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।

খাওয়া শেষ করে, কাজল এঁঠো বাসনগুলো রান্না ঘরের এক পাশে রেখে, হাত মুখ ধুয়ে সোজা বিছানায় চলে এল।

পূবের ঘরটা কাজলের শোওয়ার ঘর। খাটে বসলে খোলা জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। সামনে কিছুটা ফাঁকা জমি। তারপরেই পুকুর। পাড়ে অনেক রকমের গাছ। নারকেল, ডূমুর, জামরুল,…. একটা বিশাল নিম গাছ, কচি পাতায় ছেয়ে গেছে। আগাছার জন্য গাছগুলোর গোড়া দেখা যায় না।

নিস্তব্ধ দুপুরে কাজল গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একমনে দেখছে।
সরলা পিসিদের বাড়ির দিকে পেয়ারা গাছটা পুকুরের দিকে হেলে আছে। দুটো হাঁস জলে চড়ছে। মাছরাঙা পাখিটা ডূমুর গাছের সরু একটা ডালে বসে, একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।

পুকুরটায় কেউ স্নান করে না। জলটা কেমন যেন কালো। এক কোণে বড় বড় কচূরীপানা। মাঝেমধ্যে জেলেরা পুকুরটায় জাল দেয়। কলাবাগানের ওদিকটা দিয়ে, ওরা নামে। জালটা যাতে ভেসে থাকে, সেইজন্য একটু ছাড়া ছাড়া একটা করে বড় হাঁড়ি জালের সাথে বেঁধে দেয়। তারপর, দু-পাশ দিয়ে টানতে টানতে একেবারে কাজল-দের বাড়ির সামনে চলে আসে। তখন ও এক দৌড়ে পুকুর পাড়ে চলে যায়। জাল গুটিয়ে ওরা ছোট্ট একটা চৌবাচ্চার মত আকার করে নেয়। কাজল দেখে। ছোট বড়, কত মাছ ! সব লাফাচ্ছে !

উবু হয়ে শুয়ে, একটা পাশ বালিশ বুকে টেনে নিলো কাজল। সামনে একটা গল্পের বই। একটা গল্পের একেবারে শেষের দিক। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট মিনু’র কি হল, সেটা জানতেই হবে। এটাই শেষ পাতা। কাল রাতে পুরোটা পড়া হয়নি। মা’র বকুনির জন্য বই বন্ধ করতে হয়েছিল । একমনে সেটাই পড়তে শুরু করল।

কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ। একটানা কয়েকদিন গরমের পর, আজ একটু রেহাই।

হঠাৎ.. ‘ ঝুপুৎ! ‘… করে একটা আওয়াজ হতে কাজলের একাগ্রতায় চিড় খেলো। জলে কিছু যেন একটা পড়লো! কাজল একবার মাথাটা তুলে দেখার চেষ্টা করে,…. আবার গল্পের বইয়ে মন দিলো।

কিন্তু আবার শব্দ ! এবার একটু অন্যরকম।
……. পুকুরের ওপারের দিক থেকে আসছে মনে হচ্ছে ! নিস্তব্ধতায় শব্দটা সুক্ষ্য হলেও কাজলের কানে এসে ধাক্কা খেয়েছে।

কাজল এবার উঠে বসে পড়ে, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত হলো… হ্যাঁ, কিছু একটা জলে নড়াচড়া করছে। কিন্তু সেটা কি, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা বুঝতে ওর এতটুকু অসুবিধা হলো না…. সামনে কারও বিপদ !

কাজল খাট থেকে তাড়াতাড়ি করে নেমে, দেওয়ালে টাঙানো চাবিটা নিল। তারপর বারান্দার গেটটা খুলে, দৌড়ে পুকুর পাড়ে চলে এলো।

কাজল সাঁতার জানে না। ওপারে শতরুপা-দের ছোট ঘাট-টার কাছেই আছে। পাড় ধরে যে যাবে, সেও সম্ভব না। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ও যেতে পারবে না। কি যে করবে এখন !

উৎকন্ঠায় কাজলের হাত-পা কাঁপছে। এখনই যদি কিছু না করা যায়, তাহলে বাঁচানো যাবে না। কাজল নিশ্চিত, এটা বাচ্চাই হবে। জলে কোনোভাবে পরে গেছে। ওকে যেভাবেই হোক, বাচ্চাটাকে বাঁচাতেই হবে।
‘দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।’ ওপারে যেতে হবে। বেশ কিছুটা পথ। কাজল ঠিক করল…. ও আর এক মুহূর্তও দেরি করবে না। দৌড়বে।

দৌড় !… দৌড়…!……… দৌড়…!… পায়ের তলায় ঘাস, মাটি, নুড়ি পাথর। কাজল একটা ফ্রক পরে, খালি পায়ে.. বেহুঁস দৌড়চ্ছে। বাঁধা খোপা খুলে, চুল লুটিয়ে পরেছে ওর কপালে, ঘাড়ে, পিঠে। চুল বাধার সময় কোথায় ? ওকে যে এখুনি ওখানে পৌঁছতে হবে। না হলে সর্বনাশ।

ওপারে যেতে গেলে, বাস রাস্তা হয়ে যেতে হবে। কাজল সেইমতো দৌড়ে শতরুপা-দের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল।
কিন্তু বড়ো গেটটা তো ভেতর থেকে বন্ধ ! কাজল দু-হাতে জোরে মারতে লাগলো। টিনের দরজা। কাজলের নরম হাতের আঘাতেই, প্রচন্ড শব্দ হলো। কয়েকটা কাক কোথাও বসেছিল,ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। কুকুর একটা উৎসুক হয়ে কাজলের দিকে তাকিয়ে ছিল, দৌড়ে পালিয়ে গেল।
কিন্তু মানুষজন দেখা গেল না।
কাজল আরেকবার এদিক ওদিক দেখল…… না !… কেউ কোত্থাও নেই !
কিন্তু পাঁচিলের এক কোণের দিকে লক্ষ্য পড়তেই দেখল, ভাঙা। বেশ কয়েকটা ইট খসে নিচে পড়ে আছে। পাঁচিলটা বেশ পুরোনো। শ্যাওলা ধরা।
কাজল সামনে গিয়ে ভাঙা অংশের দু-দিকে দুটো হাতের উপর ভর দিয়ে পাঁচিলটা টপকে গেল। একটা ইট ওর ডান-পায়ের ঠিক পাশেই পড়ল। এটা বাড়ির পিছন দিক। একটা ছোট ঝুপরি আম গাছ। মাথাটা একটু নিচু করে, হাঁটতে হাঁটতে একটা শুকনো সরু গাছের ডাল তুলে নিতে ভুললো না সে।

… ছোট ঘাট-টার কাছে আসতেই কাজলের মন বিষন্নতায় ভরে গেল। দু-চোখ ছলছল করছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে নানা কু-চিন্তা …. ‘নড়াচড়া করছে না তো !’. …. মরে গেছে ?… আসতে কি তাহলে দেরি হয়ে গেল ?…..

তবু সে ঠিক করল, সে হাল হাল ছাড়বে না । জীবিত না হোক, মৃত শরীরটাকেই ও জল থেকে তুলবে।

হাতের ডালটা ওতদূর পৌঁছচ্ছে না। কাজল ছোট ঘাট-টার শেষ পাথরটায় এক পা দিয়ে আরেক পা জলের মধ্যে দিয়েছে। পাঁকে পা অনেকটা ঢুকে গেছে । এত গরমেও জল বরফের মত ঠান্ডা। কাজলের সারা শরীরে খুব দ্রুত একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সেটা জল ঠান্ডার জন্যে না হেরে যাওয়ার গ্লানির থেকে কাজল জানে না।

শুকনো ডালটা দিয়ে কাজল আস্তে করে টোকা দিতেই, নড়েচড়ে উঠলো। কাজল ভয় পেয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়েই ভাবলো, ও কি বোকা ! নড়ছে মানে তো, বেঁচে আছে !… কাজলের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।

ফ্রকটা জলে ভিজছে । ও বুঝতে পারছে, কিন্তু উপায় কি ? ডালটা দিয়ে টেনে কাছে এনে, ওটাকে আস্তে করে দু-হাতের তালুতে তুলে নিল।

বেঁচে আছে ! থরথর করে কাঁপছে । একদৃষ্টে কাজলের দিকেই তাকিয়ে আছে। কাজলও দেখছে।

এতক্ষণে শতরুপা-দের বাড়ির সকলেই বেরিয়ে পড়েছে। কাজল খেয়াল করে নি। পাঁকে গেঁথে যাওয়া পা-টা তুলে, ঘাট থেকে উঠতে উঠতে দেখল। শতরুপা’র বাবার দুটো হাত কোমরে। বেশ গম্ভীর, বললেন, ‘ কি হচ্ছে এসব! ‘

কাজল দু-হাত তুলে দেখাল, ‘ শালিক পাখির বাচ্চা, জলে পড়ে গেছিল। আর একটু হলেই ডুবে যেত। ‘

‘ আর তোর যদি আজ কিছু হয়ে যেত ?… তুই সাঁতার জানিস, যে পুকুরে নেমেছিস ! ‘… উনি একই রকম গম্ভীর।

নির্বিকার কাজল কাছের নিচু একটা ডালে পাখির বাচ্চাটাকে রেখে দিল। অসহায় শিশু-চোখ দুটো এখনও ওর দিকে চেয়ে আছে।
উপরে নিম গাছের একটা ডালে, মা পাখিটা বসে ক্যাঁ..!..
. ক্যাঁ…!.. করছে। কাজল সেই দিকেই তাকিয়ে ডাকছে,.. ‘আয়..!. আয় না …!.. তোরি তো বাচ্চা… এসে নিয়ে যা..!’
….. এইতো আমি সরে যাচ্ছি….. আয়…….

শতরুপা’র বাবার কঠোর বাস্তব কথাগুলো, মনে হয় কিশোরী কাজলের কানে গেলেও, মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না।

-সুব্রত ভট্টাচার্য

email: [email protected]

মন্তব্য করুন