Skip to content

উপন্যাস মানবিক (পর্ব নয় ) মল্লিকা রায়

গোপালের বাড়ী নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ীর দিকে হাঁটা ধরে প্রত্যুষ । ফ্ল্যাটের নীচেই চেম্বার ,সপ্তাহে তিন চার দিন পেসেন্টের ভিড় থাকে তাও আট দশজনের বেশী নয় । হার্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে প্রত্যুষ মিত্রের নাম ডাক তুঙ্গে , আজকাল অধিক সমস্যার দিনে মানুষ হার্টের সমস্যায় ভোগে বেশী যদিও সবটা প্রায় গোপালই সামলায় । ছেলেটার দায়িত্ববোধ ভাবার মতো , খাঁটি,নিষ্কলুষ, কোন দ্বিচারিতা নেই, ভাল লাগে। ভরসা জাগায় । পৃথিবীতে এখনও মানুষ আছে ,ভরসা আছে,প্রেম আছে যদিও তা সাময়িক তথাপি জীবনের কিছুটা সময় মানুষের বিশ্বাস জন্মায়, ভালোলাগা জন্মে । বিয়ের পর আলাদা ভাড়া বাসায় গোপালের বাস । কৃষ্ণার যত্নের হাতে সেখানে অথৈ শান্তির প্রলেপ ।তবে বৌমা’র আব্দার রক্ষা করতে না পারার জন্য ঘরে ঢুকেই ক্ষমা চেয়ে নেয় প্রত্যুষ । না দাদা ওসব শুনছি না বিয়ে আপনার দিয়েই ছাড়ব । আর কতদিন এভাবে কষ্ট করবেন বলুন তো ? আপনার ভায়ের তো সারাদিন ঐ একই কথা , দাদাটার যে কি হবে ? ম্লান হাসে প্রত্যুষ , ” বৌমা তোমদের এত যত্নের মধ্যে আবার তৃতীয় জনকে আনো কেন ? সে এসে তোমাদের মানিয়ে নিতে নাও পারে । বৌমা প্রত্যুত্তরে জানায়, মোটেই না সে যেমনই হোক্ আমরাই তৈরী করে নেব। পাশে গোপালেরও সায় ,”ঠিক, ঠিক ” যদি না এডযাস্ট হয় ? হুম তখন কিন্তু দোষ দিতে পাবে না বলে দিলাম “। পাশাপাশি দুই ভাইয়ের রসিকতা,খাওয়া দাওয়া যেন সেই ছোট্টবেলার দেশ গাঁয়ের মতো । আম,জাম,কাঠাল,লিচুর গন্ধে ম ম বাগানবাড়ী । যখন খুশী,যত খুশী খাও, ছড়াও বলবার কেউ নেই । সোজা ওপরে উঠে যায় প্রত্যুষ,অনেকটা পথ হেঁটে শরীরটা হালকা লাগে । আজ আর চেম্বার খোলার তাড়া নেই । অনেকটা সময় গল্প করা যাবে পর্ণার সাথে। টি ভির সুইচ অন করে,ধ্যৎ কোথাও কিছু দেখবার নেই , কদিন ধরেই শরীরটা ঠিক অবস্থায় নেই , কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করতে থাকে শরীর মনে । নাহ্ পর্ণার খবরটা নেওয়া প্রয়োজন । আলো জ্বলে ওঠে হ্যন্ডসেটের, ‘ পর্ণা , কেমন আছো ? সেলাই গুলো কাটার পর ব্যথা কমেছে ? ‘ হ্যাঁ কমেছে , বাড়ীর যত্নে একদম ওকে ” ঠিক আছে পর্ণা। যাক্ তুমি ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকি জানো ,প্রত্যুষের জবানবন্দী। শুনে খুশী হলাম , তুমি আজও আমার কথা চিন্তা কর ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম । কিছুটা সময় থাকতে দেবে তোমার কাছে যদি দীমানবাবু বাড়ীতে না থাকেন মানে আমি কি তোমার সাথে কিছুটা সময় গল্প করতে পারি ? গল্প করার মত মানসিকতা আর অামার অবশিষ্ট নেই প্রত্যুষ । কেন পর্ণা এতটা হতাশ হচ্ছ কেন তুমি ? ও তুমি বুঝবে না প্রত্যুষ,মেডিকেল.চেম্বার,পেসেন্ট ছাড়া তুমি অন্য কিচ্ছু বুঝতে পারবে না কোনদিন । আচ্ছা বল আমার দোষটা কোথায় ? আমি তো বলেছি সময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে শুধু তোমার একটু ধৈর্যের প্রয়োজন পর্ণা । হুট করে নিভে যায় সেটের আলো । পর্ণার অসহ্য ক্ষোভের কাছে । দীমানবাবু লোকটা খুব যে একটা ক্ষতিকর তেমন মনে হয় নি প্রত্যুষের,কথাবার্তায় যথেষ্ট মার্জিত ,রুচিশীলও বটে ,তবে ? ঠিক বুঝতে পারেন না ওদের মধ্যিখানের ব্যবধানটা । যদি সত্যিই নিজের স্বামীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পর্ণা তবে কেন স্টেপ নিচ্ছে না ? ঢালাও বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও চুপ করে মুখ বুঁজে পড়ে থাকার কারণ কি ? জানতেই হবে প্রত্যুষকে । ভয়ের কারণ কি ? যখন তার প্রিয় মানুষটা দু বাহু বাড়িয়ে তাকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে ? নাহ্ যা করার ওকে নিজেকেই করতে হবে । নিজেকে চিন্তামুক্ত করতে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করেন ডক্টর । আজ ফ্ল্যাটের খুশী বৌদি, দাদা, পিকলু, আড়তি বৌদি ,দাদা অনেকে দেখতে এসেছে পর্ণাকে ,টেবিলটা ফলের প্যাকেটে ভর্তি । অনেক কথা ,গল্পের পর বেশ ঝড়ঝড়ে লাগে পর্ণার ,’ খুশী বৌদি তো বলেই ফেললেন,”তুমি কিন্তু বেশ মুটিয়েছ পর্ণা । প্রাণ খুলে হাসাহাসি অনেকটা সময় । তার পরই প্রত্যূষের মন খারাপ করা মেসেজ পুরো ব্যবস্থাটায় কালি লেপে দিল যেন । ঘড়িতে রাত ন’টা বাজল। দীমান ঢুকেছে , আজ গন্ধটা বেশ তীব্র ! অনেক পেগ চড়িয়েছে মনে হয় কথাও বেশ অসংলগ্ন ,টলছে রীতিমতো । তুমি খেয়ে নাও আমি খেয়ে এসেছি,এই মনে আছে তো কাল কিন্তু উইক এন্ডের পার্টি আছে ! একদম দুষ্টুমি করবে না কিন্তু ? মাই ডার্লিং ! তোমায় অনেক অনেক গিফ্ট করবে ওরা । ঝড়ের বেগে পাশের ঘরে ঢুকে দরাম করে দরজা বন্ধ করে পর্ণা। অন্ধকারে জানালা খুলে চুপচাপ চেয়ে থাকে নীচের চলমান জগতের দিকে । ঘড়িতে বারোটার আওয়াজ । সব ঘরে ক্রমে নিভে যায় আলো, পাশের ফ্ল্যটের থেকে ভেসে অাসা সুখী পরিবারের হাসি,গল্প,কথা কানে এসে ঠেলা মারে ওর অস্তিত্বে । তলিয়ে যায় ওর কৃষ্টি , মহানুভবতা , সংসার ,ধর্ম সব । যেন সমুখে অথৈ জলের রাশি ফুলে ফেঁপে ভাসিয়ে দেবে ওর অবস্থাণটুক । অনেক যত্নে পরোটা আলুর দম বানিয়েছিল চামেলী ,বারবার মনে করিয়েছে ঠিক সময়ে খেয়ে নিতে ,পরের দিন ও জানতে চাইবে কেমন রেঁধেছিল কাশ্মীরী আলুর দমটা । এই ব্যবস্থাকে মানিয়ে নেবার কথা বলেছিল প্রত্যুষ । কিন্তু কিভাবে ? অঘোরে ঘুমোচ্ছে দীমান , সুইচ অন করে অনেক্ষণ পরে তোলে ফোন , ‘ বল, হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ সারারাত তোমার সাথে গল্প করব পর্ণা। জানি তুমি আমার উপর খুব রাগ করেছ , আচ্ছা স্বীকার করলাম আমার অন্যায় হয়েছে, বল কি বলবে, একনাগারে বলে থামে প্রত্যুষ । কি বলব মানে তুমি তো কিছুই শুনতে,জানতে চাইছ না ,নিজের কথা বলেই চলেছ । বেশ এই চুপ করলাম । বল। আমি কি করব বলো ? প্রশ্ন পর্ণার । কি করবে মানে ? কন্ঠে বিরক্তির প্রভাব । সকলে যা করে তুমিও তাই করবে । কি করে সকলে ? ক্রুদ্ধ পর্ণা , তুলসী,চন্দনে পূজো করব ? শোন প্রত্যুষ আমার এই দুর্বিসহ দিনে ভেবেছিলাম তোমার পূর্ণ সহযোগিতা পাবো কিন্তু তুমি তা করলে না, বরং ঠেলে দিলে অজানা,অন্ধকারে এই যদি হয় আমাদের ভালোবাসার পরিণতি তবে কেন ফিরে এলে তুমি ? আমার দুর্দশা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবে বলে ? রীতিমতো প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে । শোন প্রত্যুষ শেষ কথাগুলো তোমার জানা প্রয়োজন । আমি আজ জীবন মৃত্যুর চরম সীমায় দাঁড়িয়ে , যদি মরে যাই তো বেঁচে গেলে কিন্তু যদি না মরি এই তোমায় প্রতিজ্ঞা করলাম , অপরাধী শাস্তি পাবেই জেনে রেখো । আসলে আমি চেয়েছিলাম ও সংশোধন হবে, ঘরে ফিরবে , সন্তান স্বামী নিয়ে আমি গড়ে তুলব এক আদর্শ সংসার , পরিবার । সকলে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকবে বলবে , বাহ্ কি অপূর্ব ! শান্ত হয় পর্ণা বিশ্বাস করো আমি আমার অন্তর থেকে চাই ও ঘরে ফিরুক। অনেক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে নক্ করে পর্ণা , কি হলো ঘুমুলে ? নাহ্ ঘুমিয়ে পড়েছে দীমান । পাশ ফিরে শোয় মাথার পেছনটায় সামান্য ব্যথা । অন্ধকারের নীরবতায় একাকী ওর অস্তিত্ব প্রহসন করে তোলে ওকে, ভীষণরকম অশস্তি লাগছে ,ঘুমের নাম গন্ধ নেই শুধু বিছানার পরিসরে অশান্ত শরীর মনের নির্বাক পেষণ যন্ত্রণার অস্থির ক্লেদ । আবার সেটের সুইচ অন করে , এবার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় প্রত্যুষ, না পর্ণা তুমি মরার কথা বলছ কেন ? আমার জন্য তোমায় বাঁচতেই হবে বুঝলে ? না না একদম ওসব কথা মুখেও আনবে না । আবার একনাগারে বলে চলেছে দীমান । প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ জাগো দীমান । কে বলল আমি ঘুমাচ্ছি ? এইতো জেগেছি।নাও কি বলবে । না আর কিছু বলার নেই , আসলে তুমি যে শেষপর্যন্ত আমায় এভাবে এরিয়ে যাবে বুঝতে পারিনি ।ওঘরের অালো জ্বলে টয়লেটে ঢোকে দীমান।ডাইনিং এ ঢুকে ফ্রীজ খুলে ঢক্ ঢক্ করে জল খায় খানিকটা ।তারপর সিগারেটের গন্ধে বোধ হয় ওর মেজাজ রিল্যাক্সের অভ্যাসকে কিছুটা স্তিমিত করে । পর্ণার ঘরে ঢোকে আলো জ্বালে , ‘ তুমি রাতে খেয়েছিলে তো “? নিরুত্তর পর্ণা । টেবিলে রাতের খাবার তেমনই ঢাকা পড়ে আছে , ঘড়িতে রাত তিনটে ।আলো নিভিয়ে পুনরায় বিকিয়ে দেয় শরীর। দুটি প্রাণী দুটি ঘরে মাঝে বিপুল ব্যবধান, জমতে জমতে এক পৃথিবী প্রায় । কে কাছে যাবে ? কার কাছে যাবে তার প্রতিদ্বন্দিতায় অনবরত বিদ্ধ উভয়েই ,দীমানের ব্যপারটা অবশ্য একটু আলাদা , অন্তরের মূল্যবোধকে চিরবিসর্জণ দিয়ে যে মানুষ অতিকায় বিলাসের স্বপ্ন দেখে কোন পারিপার্শ্বিকতা, বিভেদ,দ্বন্দ তাকে স্পর্শ করতে পারে না কোনদিন , তখন সে কামোন্মোদনায় চির আর্ত । এক অদ্ভুত নেশাচ্ছন্নতায় হাঁটছে দীমান , কে বলে শুধু মাদক সেবনে মানুষ অসংলগ্ন হয় ? দীমান বিনা মাদকেই নেশাচ্ছন্ন । যে কোন যুক্তি,বুদ্ধি ওর কাছে অাজ নিষ্ক্রিয়। কি অদ্বুত মানুষ চরিত্র,বিশেষত পুরুষের ।গৃহের নারী যখন পরিপূর্ণ বিশ্বাসে তার আপনজনের জন্য চাদরে চিরবিশ্বাসের শিল্পে ব্যস্ত ,ব্যস্ত কোন নুতন টিফিন আইটেম তৈরীতে তার আপনজনের মুখের হাসিটুক দেখবার জন্য , ঠিক সেসময় অন্য কোন খানে তারই মুগ্ধতা জুড়ে শুয়ে থাকে নিরাভরণ শরীর অন্য ভাবে অন্য কায়দার মৃধাদের । প্রায় ভোর হয়ে এসেছে পাখীর ডাকে সদ্য শিশির ঢেলে দিল তার শেষ সোহাগের স্বেদবিন্দু পরম সাদরে ঘাসে,পাতায়, মুক্তো হয়ে আমায় চমকে দেবে বলে ।প্রথম সূর্য তার রক্তিম আলোটুক দিয়ে সাজিয়ে দিলো মণিহার , আমি ঝুঁকে পড়ে নুয়ে যাবো তার অসীম সৌন্দর্যে , গড়া হবে কাব্য সম্ভার । কিন্তু আমি যে এসময় ঢুঁ মারছি পর্ণাদের গোপন কক্ষে । দেখলাম নাহ্ মিলনের কোন প্রাক্ প্রস্তুতির তোরজোর নেই ,বুঝলেন ? আমি মহাকাল্ । সর্বখানে আমি থাকি জানেন কি? দাাঁড়ান দীমান বিছানা ছেড়ে দেরাজ খুলেছে কি যেন খুঁজে চলেছে । উরিব্বাস গুচ্ছ টাকার বান্ডিল । গুনে গুণে পুনরায় লকার বন্ধ করে ধীরে । চরিদিকে চোখ বুলিয়ে চাবিটা সন্তর্পণে গুঁজে রাখে , উহু না বলা যাবে না কোথায় । এবার নিশ্চিন্তে ঢোকে টয়লেটে । দরজায় বেল ,কাগজ,দুধের প্যাকেট হাতে চমেলী । বেশ কড়া করে চা বানা তো মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে রে, ” হাঁ ভাবী ,রান্নাঘরে ঢোকে চামেলী , টিফিনটা তাড়াতাড়ি কর , টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়ায় দীমান ,”আমায় চা দে , হাঁ ছাহাব । দু’কাপ স্পেস্যাল চা এনে টেবলে রাখে চামেলী । এ কি ভাবী কাল রাত কা খানা সব ওয়সেই হে, কুছ নাহি খায়া ? হম ইত্তা প্যর সে বনায়া অপলোগ নাহি খায়া? ভাবীকে জিজ্ঞাসা কর । উঠে ওঘরে চলে যায় দীমান । পর্ণা বেড়োয়। হ্যাঁ কি বলছিলি ? ভাবী রতকা খানা নাহি খায়া আচ্ছা নাহি হল ইসলিয়ে না ? না রে বাবা কাল তোর সাহেব বাইরে খেয়ে ফিরেছে আমারও তেমন খিদে ছিল না রে ,আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ওহ্ হম সমঝ লিয়া , কি বুঝেছিস বল ? সবসময় শুধু কথা আর কথা , যা তাড়াতাড়ি টিফিন তৈরী কর। কাগজ খুলে চোখ বোলায় পর্ণা । ধীরে পাশে এসে চুপটি করে বসে দীমান । হি হি হাসি পাচ্ছে আমার জানেন? এক্খুনি শুরু হবে লড়াই থুড়ি ঝগড়া মানে ব্যগরা । কান পাতি দাঁড়ান! আজ তোমার পার্লার ম্যম আসছেন তো না পর্ণা ? জানি এ আর নতুন কি ? আজ অামি খুব সাজব ,আশ মিটিয়ে জানো ? তোমার দেওয়া কাঞ্জিভরমটা’র ভাজ ভাঙা হয়নি আজই ভাঙব কেমন খুশী তো ? গদগদ দীমান। মাই ডার্লিং ! টেবিলে খাবার রেখে চলে যায় চমেলী মুখটা শুকনো লাগছে, থাক্ অত বকবকানি কেন ? সবসময় সব ব্যাপারে নাক গলানো । গোবি পরাঠা দারুণ বানায় চমেলি সঙ্গে চিলি সস্ ।দারুণ খুশী সাহেব । যাক্ ঝামেলা হল না তাহলে । আমার চোখ,কান কিন্তু খোলাই আছে।

মন্তব্য করুন