Skip to content

শ্রাবণগাথা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নটরাজ। আপনার ঐ সভাকবির মুখখানা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখুন। ওঁর গোমুখীবিনিঃসৃত বাক্যনির্ঝর এ দেশের কঠোর শিলাখণ্ডের উপর পাক খেয়ে বেড়াক। আমরা এনেছি সুরলোকের ধারা– আলোকের সভাপ্রাঙ্গণ ধুয়ে দিতে হবে। কাজ শেষ হলেই বিদায় নেব।
রাজা। আচ্ছা নটরাজ, তোমার পথের উপদ্রবকে নিরস্ত রাখব। পাল তুলে চলে যাও।
নটরাজ। মঞ্জুলা, তা হলে হাওয়াটা শোধন করে নিয়ে আর-একবার আবাহন গান ধরো।

তৃষ্ণার শান্তি,
সুন্দরকান্তি,
তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন।
আঁকো ধরাবক্ষে
দিক্‌বধূচক্ষে
সুশীতল সুকোমল শ্যামরসরঞ্জন।
এলে বীর, ছন্দে–
তব কটিবন্ধে
বিদ্যুৎ-অসিলতা বেজে ওঠে ঝঞ্ঝন।
তব উত্তরীয়ে
ছায়া দিলে ভরিয়ে
তমালবনশিখরে নবনীল-অঞ্জন।
ঝিল্লির মন্দ্রে
মালতীর গন্ধে
মিলাইলে চঞ্চল মধুকরগুঞ্জন।
নৃত্যের ভঙ্গে
এলে নবরঙ্গে,
সচকিত পল্লবে নাচে যেন খঞ্জন॥

রাজা। ওহে নটরাজ, সভাকবির মুখে আর শব্দমাত্র নেই। এর চেয়ে বড়ো সাধুবাদ আর আশা কোরো না।
সভকবি। আছে মহারাজ, আছে, বলবার বিষয় আছে–হঠাৎ মুখ বন্ধ করে দেবেন না।
রাজা। আচ্ছা, বলো।
সভাকবি। আমি আধুনিক বটে, কিন্তু নাচ সম্বন্ধে আমি প্রাচীনপন্থী।
রাজা। কী বলতে চাও।
সভাকবি। নৃত্যকলায় দোষ আছে, ওটাকে হেয় করেই রাখাই শ্রেয়।
রাজা। কাব্যে কোথাও কোনো দোষ সম্ভব নয় বুঝি! কত কালিদাস এবং অকালিদাস দেখা গেল, ওঁদের শ্লোকগুলোর মধ্যে পাঁক বাঁচিয়ে চলা দায় যে।
সভাকবি। কাব্য বলুন, গীতকলা বলুন, ওরা অভিজাতশ্রেণীয়, ওদের দোষকেও শিরোধার্য করতে হয়। কিন্তু ঐ নৃত্যকলার আভিজাত্য নেই, গৌড়দেশের ব্রাহ্মণরা ওকে অনাচরণীয়া ব’লে থাকেন।
নটরাজ। কবিবর, তোমার গৌড়দেশের সূচনা হবার বহু পূর্বে যখন আদিদেবের আহ্বানে সৃষ্টি-উৎসব জাগল তখন তার প্রথম আরম্ভ হল আকাশে আকাশে বহ্নিমালার নৃত্যে। সূর্যচন্দ্রের নৃত্য আজও বিরাম পেল না, ষড়্‌ঋতুর নৃত্য আজও চলেছে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। সুরলোকে আলোক-অন্ধকারের যুগলনৃত্য, নরলোকে অশ্রান্ত নৃত্য জন্মমৃত্যুর, সৃষ্টির আদিম ভাষাই এই নৃত্য, তার অন্তিমেও উন্মত্ত হয়ে উঠবে এই নৃত্যের ভাষাতেই প্রলয়ের অগ্নিনটিনী। মানুষের অঙ্গে অঙ্গে স্বর্গের আনন্দকে তরঙ্গিত করবার ভার নিয়েছি আমরাই; তোমাদের মোহাচ্ছন্ন চোখে নির্মল দৃষ্টি জাগাব নইলে বৃথা আমাদের সাধনা।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ।
হাসিকান্না হীরা পান্না দোলে ভালে;
কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে;
নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ–
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ;
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈ থৈ,তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ॥

রাজা। এর উপরে আর কথা চলে না। এখন আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি ভালোবাসি কড়া পাকের রস। বর্ষার সবটাই তো কান্না নয়, ওতে আছে ঐরাবতের গর্জন, আছে উচ্চৈঃশ্রবার দৌড়।
নটরাজ। আছে বৈকি। এসো তবে বিদ্যুন্ময়ী, শ্রাবণ যে স্বয়ং বজ্রপাণি মহেন্দ্রের সভাসদ্‌, নৃত্যে সুরে তোমরা তার প্রমাণ করে দাও।

দেখা না-দেখায় মেশা হে বিদ্যুৎলতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে এ কী ব্যকুলতা।
গগনে সে ঘুরে ঘুরে খোঁজে কাছে, খোঁজে দুরে;
সহসা কী হাসি হাসো, নাহি কহ কথা।
আঁধার ঘনায় শূন্যে; নাহি জানে নাম,
কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু দুলিছে দুর্দাম।
অরণ্য হতাশ প্রাণে আকাশে ললাট হানে;
দিকে দিকে কেঁদে ফিরে কী দুঃসহ ব্যাথা॥

নটরাজ। ওহে ওস্তাদ, তোমার গানের পিছনে পিছনে ঐ যে দলে দলে মেঘ এসে জুটল। গরজত বরখত চমকত বিজুরী। দুই পক্ষের পাল্লা চলুক। সুরে তালে কথায়, আর মেঘে বিদ্যুতে ঝড়ে।

পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগগণ-অঙ্গনে।
মন রে আমার, উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গ নে।
দিক-হারানো দুঃসাহসে সকল বাঁধন পড়ুক খসে;
কিসের বাধা; ঘরের কোণে শাসনসীমালঙ্ঘনে।
বেদনা তোর বিজুলশিখা জ্বলুক অন্তরে,
সর্বনাশের করিস সাধন বজ্রমন্তরে।
অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে হবে পথের বাহন;
শেষ ক’রে দিস আপ্‌নারে তুই প্রলয়রাতের ক্রন্দনে॥

সভাকবি। ঐ রে! ঘুরে ফিরে আবার এসে পড়ল– সেই অজানা, সেই নিরুদ্দেশের পিছনে-ছোটা পাগলামি।
নটরাজ। উজ্জয়িনীর সভাকবিরও ছিল ঐ পাগলামি। মেঘ দেখলেই তাঁকেও পেয়ে বসত অকারণ উৎকণ্ঠা; তিনি বলেছেন, মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ– এখানকার সভাকবি কি তার প্রতিবাদ করবেন।
সভাকবি। এত বড়ো সাহস নেই আমার। কালিদাসকে নমস্কার ক’রে যথাসাধ্য চেষ্টা করব মেঘ-দেখা হাহুতাশটাকে মনে আনতে।
নটরাজ। আচ্ছা, তবে থাক্‌, কিছুক্ষণ হাহুতাশ, এখন অন্য কথা পাড়া যাক। মহারাজ, সব চেয়ে যারা ছোটো, উৎসবে সব চেয়ে সত্য তাদেরই বাণী। বড়ো বড়ো শাল তাল তমালের কথাই কবিরা বড়ো করে বলেন– যে কচি পাতাগুলি বন জুড়ে কোলাহল করে তাদের জন্যে স্থান রাখেন অল্পই।
রাজা। সত্য বলেছ, নটরাজ। ক্রিয়াকর্মের দিনে পাড়ার বুড়ো বুড়ো কর্তারা ভাঙা গলায় হাঁকডাক করে, কিন্তু উৎসব জমে ওঠে শিশুদের কলরবে।
নটরাজ। ঐ কথাটাই বলতে যাচ্ছিলুম। কিশলয়িনী, এসো তুমি শ্রাবণের আসরে।

ওরা অকারণে চঞ্চল;
ডালে ডালে দোলে বায়ু হিল্লোলে
নব পল্লবদল।
বাতাসে বাতাসে প্রাণভরা বাণী
শুনিতে পেয়েছে কখন কী জানি,
মর্মরতানে দিকে দিকে আনে কৈশোর-কোলাহল।
ওরা কান পেতে শোনে গগনে গগনে মেঘে মেঘে কানাকানি,
বনে বনে জানাজানি।
ওরা প্রাণ-ঝরণার উচ্ছল ধার
ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল॥

পরবর্তী অংশ পড়তে ক্লিক করুন

Pages: 1 2 3 4 5

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।