Skip to content

মৃত্যুক্ষুধা – পর্ব – ৪ – কাজী নজরুল ইসলাম

প্যাঁকালে চলে যাওয়ার পরই তার দ্বাদশটি ক্ষুধার্ত ভাইপো-ভাইঝি মিলে বিচিত্র সুরে ‘ফরিয়াদ’করতে লাগল ক্ষুধার তাড়নায়, তাতে অন্নের মালিক যিনি, তিনি এবং পাষাণ ব্যতীত বুঝি আর সব-কিছুই বিচলিত হয়।

সেজোবউ হপ্তাকানিক হল টাইফয়েড থেকে কোনো রকমে বেঁচে উঠেছে। কিন্তু ওই বেঁচে উঠেছে মাত্র। বেঁচে থাকার চিহ্ন শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু ছাড়া তার আর কিছু নেই। দেহের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা কবরে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। যেন কুমিরে চিবিয়ে গিলে আবার উগলে দিয়ে গেছে।

কসাই যেমন করে মাংস থেঁতলায়, রোগ-শোক-দুঃখ-দারিদ্র্য এই চারটিতে মিলে তেমনই করে যেন থেঁতলেছে ওকে।

ওরই কোলে খোকা – স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকু। মাত্র দু মাসের! জন্মে অবধি মায়ের দুধ না পেয়ে শুকিয়ে চামচিকের মতো হয়ে গেছে।

শুষ্ক ক্ষীণকণ্ঠে অসহায় শিশু কাঁদে, আর একবার করে তার কণ্ঠের চেয়েও শুষ্ক মায়ের বুকে একবিন্দু দুধের আশায় বৃথা কান্না থামায়। আবার কাঁদে। কান্না তো নয়, যেন বেঁচে থাকার প্রতিবাদ। যেন ওকে কে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।

ওরা মা-ই তখন চেঁচিয়ে বলে, “আল্লা গো, আর দেখতে পারিনে, তুলে নাও বাছাকে তোমার কাছে। ও মরে বাঁচুক।”

চোখের জলে বুক ভেসে যায়।

খোকা কান্না থামিয়ে সেই নোনাজল চাটে, আবার কাঁদে।

মেয়েদের ঘর থেকে শাশুড়ি তার নবাগত নাতিকে মেয়ের কোলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এসে কান্নাকটু কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, “মর মর মর তোরা! এত লোককে নেয়, আর তোদেরই ভুলেছে যম।”তারপর বউদের উদ্দেশ করে বলে, “নে লো বেটাখাকিরা, তোদের এই হারামদের মাথা চিবিয়ে কা। মাগিরা শুয়োরের মতো ছেলে বিইয়েছে সব। বাপরে বাপ! জান যেন তিতবিরক্ত হয়ে গেল!”বলেই সে উচ্চৈঃস্বরে তার মৃত পুত্রদের নাম করে কাঁদে। ততক্ষণে বড়ো-বউ জলের ঘড়াটা নামিয়ে বড়ো ছেলেমেয়ে দুটোকে ধরতে না পেরে এক বছরের ছোটো মেয়েটার পিঠেই মনের সাধে ঝাল মেটাতে থাকে।

মেজোবউ ছাড়াতে যায়, পারে না। মেয়েটাকে ছাড়াতে গিয়ে তারও পিঠে পড়ে দু-এক ঘা! মেজোবউ হাসে, আর বাকি ছেলেগুলোকে পালাবার ইঙ্গিত করে।

তার নিজের ছেলেমেয়ে দুটির দিকে চেয়েও দেখে না। ওরা যেন ওদের মায়ের গুণ পেয়েছে। বাড়ির মধ্যে ওই ছেলেমেয়ে কয়টাই যা শান্ত। খিদে পেলে চুপি চুপি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “মা,বড্ড খিদে পেয়েছে।”

আজও মেজোবউ যখন বড়োবউ-এর ক্রন্দনরত ছোটো মেয়েটাকে বুকে করে দোলা দিতে দিতে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, তখন তার ছেলেমেয়েরা স্থির সান্তভাবে একটা কাঁচা কয়েতবেল ভেঙে সেইটে দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করছিল। কেবল ছোট ছেলেটি তার মায়ের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল।

হঠাৎ সে বলে উঠল, “বুবু। অ-বু-উ! মা আবার মেনিকে নেমিয়ে দেবে কোল থেকে?”

কাঁচা কয়েতবেলের কষার রসে তার বুবুর জিহ্বা তখন তালুতে ঠেকেছে গিয়ে। সে কোনোরকমে বললে, “হুঁ”।

মেজোবউ তার ছেলেমেয়ের দিকে ফিরে বললে, ”পটলি, যা দেখি চারটে কাঠ কুড়িয়ে আন গিয়ে, আমি তোদের তরে ক্ষীর রেঁধে দিচ্ছি।”

মায়ের ভয়ে যে ছেলেমেয়ে কয়টির এতক্ষণ উদ্দেশ ছিল না, ক্ষীরের উল্লেখে তারা এইবার যেন মন্ত্রবলে পাতাল ফুঁড়ে বেড়িয়ে এল।

মেজোবউকে ঘিরে নেচে-কুঁদে তার কাপড় টেনে চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে ওরা যেন একটা পেল্লায় কাণ্ড বাধিয়ে দিলে। যেন মেজোবউকে ছিঁড়ে খাব।

এক পাল ছাতার পাখি যেন একটা পোকা দেখতে পেয়েছে।

মেজোবউয়ের ছোটো ছেলেটি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, এইবার সে আস্তে আস্তে তার ক্রন্দন-রত দাদির কোলে এসে বসে কী ভাবতে লাগল; তারপর তার গায়ের ছেঁড়া ময়লা জামাটা খুলে দাদির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, “দাদি, চুপ কর, মা ক্ষীর রাঁধছে, তুই খাবি, আমি খাব, বু খাবে।”

তার দাদির কান্না থামে। ওই ক্ষুদ্র শিশু! তার বাবাও ছিল ছেলেবেলায় ঠিক এমনটিই দেখতে। কার জন্য কাঁদছে সে? এই তো তার সোভান। ওই যাদের এত করে গালি দিচ্ছিল সে, তারাই তো তার বারিক গজালে। খিদে পেলে এমনই করে কাঁদত তারা। কাঁদলে সোভান এমনই করে কোলে বসে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলত, “মা, তুই কাঁদিসনে, আমি বড়ো হয়ে তোকে তিন কুড়ি টাকা এনে দেব।”কে বলে সোভান মরেছে? এই তো সে-ই এসেছে আবার তেমনই খোকাটি হয়ে। এই তো রয়েছে তার গলা জড়িয়ে ধরে। চুমায় চোখের জলে শিশুর মুখ অভিষিক্ত করে দেয়।

শিশুর ক্ষুদ্র মুখ ঝলমল করে চিরদুঃখিনীর কোলে –যেন বর্ষা রাতের ম্লান চাঁদ।

শিশু হঠাৎ দাদির কোল থেকে উঠে দৌড়ে মায়ের গায়ে মাথা হেলান দিয়ে বসে। আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে কী ভাবে। চোখের সামনে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুঘু উড়ে যায়। নীল স্বচ্ছ আকাশ রোদ লেগে যেন আরও করুণ হয়ে ওঠে। কত দূর ওই আকাশ!

হঠাৎ সে মার আঁচল টেনে বলে,“মা, তুই যে বলেছিলি, ক্ষীর-পরবের দিন বা-জান (বাবা) আসবে। আজ আমরা ক্ষীর রাঁধছি যে, বা-জান আসবে ও-ই মেঘ ফুঁড়ে! লয়?”

মা শুকনো পাতার উপর লুটিয়ে পড়ে। মুখের গান তার চোখের জলে ভেসে যায়!–

শুকনো আমপাতা আপন মনে পুড়তে পুড়তে তার দিকে এগোয়।

শাশুড়ি ছুটে এসে লুটিয়ে-পড়া বউকে তুলবার চেষ্টা করতেই মেজোবউ অমনি ধড়মড়িয়ে ওঠে, তারপর কাঠি দিয়ে উনুনে পাতা ঠেলে।

এইবার খোকা কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকে।

তার দাদি বলে, “দেখ বউ, সোভান দিনরাত এমনই মন-মরা হয়ে থাকত ছেলেবেলা থেকেই।”

মেজোবউ আবার গুন গুন করে গান করে।

শাশুড়ি বলে, “ আ মলো যা‌! ছুঁড়ি যেন দিনকের দিন কচি খুকি হয়ে উঠছে! যখনই কান্না, তখনই হাসি।” বলেই খোকাকে টেনে কোলে তুলে অকারণে সারা উঠান ঘুরে বেড়ায়।

খোকা অনর্গল প্রশ্ন .করে, “দাদি গো, বা-জান এখণ খু-ব বড়ো হয়ে গেয়েছে –লয়? সেই যে কয়েছিল, আমার জন্যে বিস্কুট আনবে –। হু-ই গোয়াড়ির বাজার – সে এনেক দূর! লয় দাদি? এনেক দিন লাগে যেতে আসতে। লয় দাদি? আমার লাল জামাটা লালুকে দিয়ে দিব, বা-জান আর একটা লাল জামা আনবে। লয় দাদি?

দাদি কতক শোনে, কতক শোনে না। উঠোনময় ঘুরে বেড়ায়।

সেজোবউ শুয়ে শুয়ে ক্ষীর-রান্না দেখে। কচি ছেলেটা ততক্ষণে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে মায়ের বুকের হাড়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

ক্ষীর-রান্না হয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা যে যেখানে যা পায় – থালা, বাটি, ঘটি, বদনা – তাই নিয়ে উনুন ঘিরে বসে যায়।

অপূর্ব সেই ক্ষীর‌! অদূরে দারোগা মির্জা সাহেবের বাড়ি। তাঁরই বাড়ির দুধ বেড়ালে খেতে না পেরে যেটুকু ফেলে গিয়েছিল, তাই দারোগা-গিন্নি পাঠিয়ে দিয়েছেন এদের বাড়ি। তাঁর অপার করুণা, তাই সে স্বল্প দুধে জল মিশিয়ে আধ-পোয়া দুধকে আধ সের করে ঝি-র হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই না-চাইতেই জল পেয়ে এদের সকলের চোখ দিয়ে যে কৃতজ্ঞতার জল পড়েছে, তা ওই আধ-সের জলের অনেক বেশি।

বাড়িতে চাল ছিল সেদিন বাড়ন্ত। মুরগির সদ্য খোলা হতে ওঠা বাচ্চাগুলির জন্য যে খুদগুঁড়ার রিজার্ভ স্টোর ছিল ছটাক তিনেক, দারোগা-বাড়ির দুগ্ধ সংযোগে তাই সিদ্ধ হয়ে হল এই উপাদেয় ক্ষীর। এই ক্ষুধিত শিশুদের এই আজকের সারাদিনের আহার।

এই তাদের ক্ষীর-পরব ঈদ।

লবণ-সংযোগে শিশুদের সেই অপূর্ব পরমান্ন দেখে চোখে জল এল শুধু মেজোবউয়ের।

সে তাড়াতাড়ি কচার বেড়ার কাছে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কয়েকটা কচাপাতা নিয়ে কাঠি দিয়ে সিইয়ে তাই বাটির মতো করে তাতে খানিকটা ক্ষীর ঢেলে সেজোবউয়ের কাছে এনে ধরল।

সেজোবউ উঠে বসে করুণ ক্ষীণ কণ্ঠে বললে, “মেজো-বু, তুমি?”

মেজোবউ একটু হাসলে। রাহুগ্রস্ত চাঁদের কিরণের মতো ম্লান পাণ্ডুর সে হাসি।

সেজোবউ মেজোবউকে জানত। সে আর কিছু না বলে খেতে খেতে হঠাৎ থেমে বলে উঠল, “খোকা কি এই ক্ষীর খাবে মেজো-বু?”

মেজোবউ বললে, “সে কথা তোকে ভাবতে হবে না, খোকার জন্যে দুধ রেখেছি। উঠলে খাইয়ে দেব।”

বড়োবউ জলের ঘড়াটা নামিয়ে রেখে হাতটা আগুনের তাতে ধরে বলে উঠল, “উঃ কোমর কাঁকাল ধরে গেল মেজোবউ, কাল থেকে তুই জল আনিস আমি বরং ধান ভানব।” বলেই হাতটা সেঁকতে সেঁকতে বলতে লাগল, “আমার হাত ফুলে গেল, গতরখাগিকে মারতে মারতে। হারামজাদির পিঠ তো নয়, পাথর!”

ছেলেমেয়েরা ততক্ষণে ক্ষীর খেয়ে মহানন্দে ‘বউ পালালো’খেলছে! ওদেরই একজন পলায়নপরায়ণা বধূ হয়ে তার না-জানা বাপের বাড়ির পানে দৌড়েছে এবং তার পিছনে বাকি সবাই গাইতে গাইতে ছুটছে –

“বউ পালাল বউ পালাল খুদের হাঁড়ি নিয়ে,
সে বউকে আনতে যাব মুড়ো ঝ্যাঁটা নিয়ে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।