Skip to content

মৃত্যুক্ষুধা – পর্ব – ২১ – কাজী নজরুল ইসলাম

পরদিন সকালে না হতেই কৃষ্ণনগরে একটা হইচই পড়ে গেল! দলে দলে পুলিশ এসে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বাড়িতে খানাতল্লাশ করতে লাগল। বহু ছাত্র ও তরুণকে হাজতে পুরল।

আনসারকে ধরবার জন্যে সশস্ত্র রিজার্ভ পুলিশ সারা রাত্রি ধরে বাগানের গাছে, নাজির সাহেবের আনাচে-কানাচে পাহারা দিচ্ছিল, ভোর না হতেই তারা ঘুমন্ত আনসারকে বন্দী করল।

শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেল, নাজির সাহেবের শালা আনসার রুশিয়ার বলশেভিক-চর ও বিপ্লবী-নেতা। সে ছেলেদের মধ্যে কম্যুনিস্ট মতবাদ প্রচার করছিল এবং তাদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল।

সবচেয়ে বেশি ঘামতে লাগলেন সেসব ভদ্রলোক, যাঁরা নিজে বা তাঁদের কোনো আত্মীয় ধরা পড়ে নাই। তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, “বাবা! খুব বাঁচা গেছে! যে রকম জাল ফেলেছিল পুলিশ! মনে হচ্ছিল, গুগলি শামুক পর্যন্ত বাদ দেবে না।”

ওরই মধ্যে একজন বলে উঠলেন, “আমরা চুনোপুঁটি, ওরা রুই-কাতলাই ধরতে এসেছিল!”

আর একজন আর একটু মাত্রা চড়িয়ে বললেন, “হাঁ দাদা, সরকার খলিফা ছেলে, ও ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না! মশা মারতে কামান দাগে না!”

স্বদেশ-ব্রত বীরের দল গালি খেতে লাগল, তাদের তথাকথিত হঠকারিতার জন্য – তাদেরই কাছে বেশি, যাদের অধীনতা-পাশ ছিন্ন করবার জন্য তাদের সুখের গৃহ ও আত্মীয়-স্বজন হতে হয়তো চিরকালের জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

আনসারের ধৃত হওয়ার সংবাদ শহরময় রাষ্ট্র হয়ে পড়ল এবং সবাই জানতে পারল যে, আনসার এখনও বাড়িতে বন্দী অবস্থায় আছে। দলে দলে মেথর-কুলি, গাড়োয়ান-কোচোয়ান, কৃষক-শ্রমিকের দল নাজির সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। পুলিশের মার-গুঁতো-চাবুক-লাথিতে ভ্রুক্ষেপ না করে তারা নাজির সাহেবের ঘর ঘিরে ফেললে। পুলিশ উপায়ান্তর না দেখে দু একটা ফাঁকা আওয়াজও করলে বন্দুকের। কিন্তু কেউ এক পাও পিছুল না। ওরই মধ্যে এক বৃদ্ধ মেথর চিৎকার করে বলে উঠল, “হুজুর, আমাদের বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ওর চেয়ে মার আর কী আছে? আমাদের বুকে বরং গুলি মারো, আমাদের বাবাকে ছেড়ে দিয়ে যাও।”

ওর ক্রন্দনে শুনে কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারলে না!

বাইরে জন-সংঘ ক্রন্দন-কাতর কণ্ঠে আকাশ-ফাটা জয়ধ্বনি করে উঠল! ও যেন বিক্ষুদ্ধ গণ-দেবতার, পীড়িত মানবাত্মার হুংকার!

আনসারের চোখের কানায় অশ্রু টলমল করে উঠল। সে তার শৃঙ্খলাবদ্ধ কর ললাটে ঠেকিয়ে জনসংঘের উদ্দেশে নমস্কার করে বলে উঠল, “আমি জানি, তোমাদের জয় হবে! তোমাদের কণ্ঠে স্বাধীন মানবাত্মার শঙ্খধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।”

প্রমত্ত জনসংঘকে কিছুতেই টলাতে না পেরে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট আনসারের কাছে এসে বললে, “আপনি যদি কিছু বলেন ওদের, তাহলে বোধ হয় ওরা যাবে। নইলে বাধ্য হয়ে আমাদের গুলি চালাতে হবে।”

আনসার হেসে বললে, “আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু গুলির ভয়ে আমি যাচ্ছি না। গুলি যদি সত্যিই চালাবেন মনস্থ করে থাকেন, তাহলে গুলি চালান।” বলেই হেসে বললে, “আমরা গুলিখোরের জাত। ওটা ধাতে সয়ে গেছে।”

সায়েব একটু হেসে বললে, “গুলি সত্য-সত্যই চালাতে চাই না। কিন্তু আপনাকে তো থানায় যেতে হবে। ওরা আমাদের কর্তব্যকাজে হয়তো বাধা দেবে!”

আনসার তেমনই হেসে বললে, “তাহলে আপনারাও আপনাদের কর্তব্য করবেন। কিন্তু তা বোধহয় করতে হবে না। চলুন।”

শৃঙ্খলাবদ্ধ আনসারকে দেখেই উন্মত্ত জনতা বিপুল জয়ধ্বনি করে উঠল। আনসার তাদের হাসিমুখে নমস্কার করে বললে, “তোমরা ফিরে যাও। ভয় নেই, আমার ফাঁসি হবে না। আবার আমি ফিরে আসব তোমাদের মাঝে।” একটু থেমে উদ‍্‍গত অশ্রু কষ্টে নিরোধ করে বললে, “আমার নিজের জন্য কোনো দুঃখ নেই ভাই, কারণ আমার জন্য দুঃখ করবার কেউ নেই –”

অমনই সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠল, “আছে, আছে! আমরা আছি!”

আনসার হেসে বললে, “জানি, তোমরা আছ। কিন্তু তোমরা তো আমার জন্য কাঁদবার বন্ধু নও! আমি যদি পরাজিতই হয়ে থাকি, তোমরা জয়ী হয়ে আমার সেপরাজয়ের লজ্জা মুছে দেবে।”

অমনই সহস্র কণ্ঠে ধ্বনি উঠল, “নিশ্চয়, নিশ্চয়।”

পুলিশ সাহেব অসহিষ্ণু হয়ে উঠতেই আনসার বললে, “ভয় পাবেন না, আমি ওদের খেপিয়ে তুলব না, শান্তই করব।”

তারপর জনগণের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “বন্ধুগণ! আমার বিদায়কালে তোমাদের প্রতি আমার একমাত্র অনুরোধ, তোমরা তোমাদের অধিকারের দাবি কিছুতেই ছেড়ো না। তোমাদেরও হয়তো আমার মতো করেই শিকল পরে জেলে যেতে হবে, গুলি খেয়ে মরতে হবে, তোমরাই দেশের লোক তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে, সকল রকমে কষ্ট দেবে, তবু তোমরা তোমাদের পথ ছেড়ো না, এগিয়ে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত হোয়ো না। আগের দল মরবে বা পথ ছাড়বে, পিছনের দল তাদের শূন্যস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। তোমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়েই আসবে তোমাদের মুক্তি। অস্ত্র তোমাদের নেই, তার জন্য দুঃখ কোরো না। যে বিপুল প্রানশক্তি নিয়ে সৈনিকেরা যুদ্ধ করে, সেই প্রাণশক্তির অভাব যদি না হয় তোমাদের, তোমরাও জয়ী হবে। আর অস্ত্র বা নাই বলব কেন? কোচোয়ান! তোমার হাতে চাবুক আছে? বুনো ঘোড়াকে – পশুকে তুমি চাবুক শায়েস্তা কর, আর মানুষকে শায়েস্তা করতে পারবে না! রাজমিস্ত্রি! তোমার হাতের কন্নিক দিয়ে ফুটগজ দিয়ে এত বাড়ি-ইমারত তৈরি করতে পারলে, বুনো প্রকৃতিকে রাজলক্ষ্মীর সাজে সাজালে – পীড়িত মানুষের নিশ্চিন্তে বাস করার স্বর্গ তোমরাই রচে তুলতে পারবে। আমার ঝাড়ুদার, মেথর ভাইরা, তোমরাই তো নিজেদের অশুচি অস্পৃশ্য করে পৃথিবীর শুচিতা রক্ষা করছ, নিজে সমস্ত দূষিত বাষ্প গ্রহণ করে, আয়ুক্ষয় করে, আমাদের পরমায়ু বাড়িয়ে দিয়েছ, আমাদের চারপাশের বাতাসকে নিষ্কলুষ করে রেখেছ! তোমরা এত ময়লাই যদি পরিষ্কার করতে পারলে – তাহলে এই ময়লা-মনের ময়লা মানুষগুলোকে কি শুচি করতে পারবে না? তোমাদের মতো ত্যাগী করতে পারবে না? তোমাদের ওই ঝাড়ু দিয়ে ওদের বিষ-ময়লা ঝেড়ে ফেলতে পারবে না? – তুমি চাষা? তুমি যে হাল দিয়ে মাটির বুকে ফুলের ফসলের মেলা বসাও, সেই হাল দিয়ে কি এই অনুর্বর-হৃদয়, মানুষের মনে মনুষ্যত্বের ফসল ফলাতে পারবে না?

‍জনসংঘ মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি করতে লাগল। সে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পুলিশ সাহেব বাধা দিল।

আনসার হেসে বললে, “ভয় নেই সাহেব! এ-রকম বক্তৃতা অনেক দিয়েছি, কিন্তু ওই জয়ধ্বনি ছাড়া ওদেরকে খেপিয়ে তুলতে পারিনি। আজও পারব না। খ্যাপানোর মানুষ আমার পিছনে আসছে! আমার মুখ তো বহুদিনের জন্যই এখন বন্ধ করে দেবে, যাওয়ার বেলায় না-হয় একটু আলগাই করলুম! যাক, আমি আর কিছু বলব না! এবার ওদের ফিরে যেতেই বলব!”

বলেই জনসংঘের দিকে ফিরে বললে, “আমার অনুরোধ, তোমরা ফিরে যাও। আমার পিছনে যদি যেতে হয়, তো সে পথ শুধু ওই থানাটুকু বা তারও বেশি জেল পর্যন্ত, কিন্তু তোমাদের দেশ-লক্ষ্মীকে খুঁজতে হলে স্বর্ণ-লঙ্কা পর্যন্ত যেতে হবে। স্বর্গে উঠে যেতে হবে, পাতালে নেমে যেতে হবে।”

‍তারপর পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললে:

“এই বেচারারা তোমাদের আমাদের মতোই হতভাগ্য, দুঃখী। পেটের দায়ে পাপ করে, দেশদ্রোহী হয়। ওদের ক্ষমা করো, দুদিন পরে ওরাও আসবে তোমাদের কমরেড হয়ে। যে মৃত্যু-ক্ষুধার জ্বালায় এই পৃথিবী টলমল করছে, ঘুরপাক খাচ্ছে তার গ্রাস থেকে বাঁচবার সাধ্য কারুরই নেই। তোমরা মনে রেখো, তোমরা আমর উদ্ধারের জন্য এখানে আসনি, তোমাদের সে-মন্ত্র আমি কোনোদিনই শিখাইনি, তোমরা তোমাদের উদ্ধার করো – সেই হবে আমারও বড়ো উদ্ধার। তোমাদের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি হব মুক্ত। এসেছে, নমস্কার নাও, আমার দোষ ত্রুটি অপরাধ ক্ষমা করো, তারপর যদি আসতেই হয় আমার পথে, সংঘবদ্ধ হয়ে এসো আমার পিছনে। বিপুল বন্যার বেগে এসো, এক মুহুর্তের জোয়ারের রূপে এসো না। আমি ভেসে চললুম দুঃখ নেই, কিন্তু তোমরা এসো। নমস্কার!”

উপস্থিত সকলেই জয়ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে ললাটে কর ঠেকিয়ে সালাম ও নমস্কার করল।

পুলিশ আনসারকে নিয়ে গেল! আশ্চর্য! কেউ আর বাধা দিল না! থানাতেও গেল না! বজ্রগর্ভ মেঘের মতো ধীর-শান্ত গতিতে নিজ পথে চলে গেল।

যাওয়ার সময় সবচেয়ে মুশকিল হয়েছিল – লতিফাকে নিয়ে! সে কেবলই ঘন ঘন মূর্ছা যাচ্ছিল। আনসার যখন গেল তখনও সে মূর্ছিতা। আনসার নীরবে ধুলায় লুণ্ঠিতা তার ললাটে, শিরে বারবার হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, “বুঁচি, ওঠ ওঠ। তুই অমন করিসনে। আমি আবার আসব।” আনসারের অশ্রু-সাগরে যেন অমাবস্যার রাতের জোয়ার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল!…

পরদিন প্রত্যুষে রানাঘাট স্টেশনে শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রহরী-বেষ্টিত অবস্থায় আনসার যখন গাড়িতে বদল করছিল, তখন হঠাৎ চোখ পড়ল অদূরের কয়েকটি যাত্রীর প্রতি! তারা আর কেউ নয়, মিস জোন্স, মেজোবউ, প্যাঁকালে এবং কুর্শি।

মিস জোন্স এগিয়ে এসে হাসি চেপে বললে, “আপনার এ অবস্টা ডেখে দুঃখিট, মিস্টার আনসার!”

আনসার হেসে বললে, “ধন্যবাদ! তারপর, ওদের নিয়ে কোথায যাচ্ছেন?”

মিস জোন্স বললে, “বরিশালে! আপনাদের মেজোবউ তো কাল বেঁকে বসেছিল সে আর গির্জায় থাকবে না। আবার মুসলমান হবে, ঘরে ফিরে যাবে। সে কী কান্না, মিস্টার আনসার! কিন্তু আজ সকালে দেখি, এসে বললে, –সে এদেশে থাকতে চায় না! আজ কিন্তু সারাদিন কেঁদেছে ও! ওর মাথায় বোধ হয় ছিট আছে, মিস্টার আনসার! হ্যাঁ, আর আপনি শুনে বোধহয় খুশি হবেন, কাল প্যাঁকালেও আমাদের পবিত্র ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। কুর্শির সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। জিশুখ্রিস্ট ওদের সুখী করুন! গুড বাই!”

ট্রেন এসে পড়ল। আনসার দেখতে পেল ইঞ্জিনের অগ্নিচক্ষুর মতোই অদূরে দুটি চক্ষু জ্বলছে। মৃত্যু-ক্ষুধার মতো সে-চাউনি জ্বালাময়, বুভুক্ষু, লেলিহান। সে-চোখে অশ্রু নাই, শুধু রক্ত।

ট্রেন ছেড়ে দিল। আনসার তার চোখের জলের ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেল, প্লাটফর্মে, কাকে যেন অনেকগুলো লোক আর মিস জোন্স ধরাধরি করে তুলছে।

রেলগাড়ির ধোঁয়ায় আনসারের চোখ এবং প্লাটফর্ম সব আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।