Skip to content

মৃত্যুক্ষুধা – পর্ব – ১৯ – কাজী নজরুল ইসলাম

চাঁদসড়কে সেদিন ভীষণ একটা হইচই পড়ে গেল, মেজোবউ তার ছেলেমেয়ে নিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে।

সত্যি-সত্যিই সে খ্রিস্টান হয়ে গেছে। তবে তার একটু ইতিহাসও আছে।

মেজোবউ কিছুদিন থেকে খ্রিস্টান মিশনারি মিস জোন্সের কাছে গিয়ে একটু সেলাই ও লেখাপড়া শিখছিল। মিশনারিরা ওদের ধর্মপ্রচারের জন্য হয়তো একটু গায়ে পড়েই দরিদ্র মুসলমান ও হিন্দুদের অসুখ-বিসুখে ওষুধ-পত্তর দিয়ে সাহায্য করে এবং তারা অনেককে তাদের ধর্মে দীক্ষিতও করতে পরেছে। কিন্তু মেজোবউয়ের ব্যাপার একটু অন্য রকম।

মিস জোন্সের কীজন্য জানি না, প্রথম দেখাতেই মেজোবউকে চোখে ধরে গিয়েছিল। শুধু চোখে নয়, হয়তো মনেও। মেজোবউয়ের নামে পাড়ায় একটা বদনামও আছে যে, ওকে একবার দেখলে ভালো না বেসে পারা যায় না।

মেজোবউ সুন্দরী! কিন্তু ওই সৌন্দর্যটুকুই ওর সব নয়। এক একজন মানুষের চোখে-মুখে এক একটা জিনিস থাকে, যার জন্য তাকে দেখামাত্রই মনটা খুশি হয়ে ওঠে, ‘তুমি’বলে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। শ্রী, লাবণ্য, সুষমা –এর কোনো-একটা নাম দিয়ে ওর মানে করা যায় না। অমনই মায়া-মাখানো চোখ-মুখ মেজোবউয়ের!…

পাড়ায় পুরুষ মেয়ে সবাই বলতে লাগল, এইবার মাগিরা মেজোবউকে ‘আড়কাঠি’করে সব বউ-ঝিকে ‘খেরেস্তান’করে তুলবে।

প্যাঁকালের মা-র চিৎকার ও কান্নায় সমস্ত পাড়া সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সে কান্না-চিৎকারে দিবারাত্রির মধ্যে বিরাম ছিল না। কখনও তা অচল হয়ে তাদের ঘরের আঙিনা থেকেই দিগ্-দিগন্তরে পরিব্যাপ্ত হতে লাগল, কখনও বা সচল হয়ে চাঁদসড়ক থেকে কুর্শিপাড়া – কুর্শিপাড়া থেকে কাঠুরেপাড়া – কাঠুরেপাড়া থেকে হাটবাজার ঘুরে – গির্জা-মসজিদ প্রদক্ষিণ করে ফিরতে লাগল।

মেম-সায়েবদেরে সে যে-ভাষায় আপ্যায়িত করতে লাগল তার তুলনা মেলা ভার।

ভাগ্যিস মেম-সায়েবরা আমাদের বাংলা ভাষার সব মোক্ষম-মোক্ষম গালির অর্থ বোঝে না, বুঝলে তারা মেজোবউকে কাঁধে করে তার বাড়ি বয়ে রেখে যেত!

কলকাতায় প্যাঁকালেকে খবর দেওয়া হল। কুর্শি বিশেষ করে তাগিদ ও পরামর্শ দিতে লাগল ওদের বাড়ি এসে যে, এ সময় প্যাঁকালে এসে একটা ‘ধুমখাত্তর’কাণ্ড বাঁধিয়ে দেবে! চাই কী – সে যা পুরুষ মর্দ, মেম-সায়েবকেও ধরে নিয়ে আসতে পারে ইচ্ছে করলে।

পাড়ার মসজিদের মোল্লা সাহেব সেদিন মগরেবের নামাজের পর নিজে যেচে প্যাঁকালেদের বাড়ি মউলুদের ও তৎসঙ্গে বেইমান নাসারাদের বজ্জাতি সম্বন্ধে ওয়াজের জলসা বসালেন। পুরুষ-মেয়েতে বাড়ি সরগরম হয়ে উঠল। মউলুদ ও ওয়াজের পর স্থির হল যে, কালই মওলানা হযরত পির গজনফর সাহেব কেবলা ও মওলানা রুহানী সাহেবকে এই গোমরাহ্ বেদীনদের নসিহত ও দরকার হলে ‘বহস’ করার উদ্দেশ্যে আনবার জন্য লোক পাঠাতে হবে এবং তার সমস্ত খরচ বহন করবে পাড়ার লোকেরা। প্যাঁকালের মা আপাতত তার বাড়ির ছাগল কয়টা বিক্রি করে পনেরো টাকা জোগাড় করে দেবে। নইলে সে সমাজে ‘পতিত’থাকবে।

আনসার সব শুনেছিল তার বোনের কাছে। কাজেই সে বেশ একটু উৎসাহ নিয়েই এ নিয়ে পাড়ায় কী হয় শুনতে এসেছিল মউলুদের জলসাতে। সব শোনার পর একটি কথাও না বলে নাজির সাহেবের বাসায় ফিরে গেল।

বাসায় গিয়েই ইজিচেয়ারটাতে শুয়ে বললে, “ওরে বুঁচি, বড্ড মাথা ধরেছে, একটু চা দিতে পারবি?”

লতিফা হেসে বললে, “না, পারব না! কী হল দাদু ওদের সভায়, বললে না যে!”

আনসার তিক্তস্বরে বলে উঠল, “ঘোড়ার ডিম! মেজোবউ হল খ্রিষ্টান, লাভ হল পির আর মওলানা সাহেবদের। আর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা –বেচারি প্যাঁকালের মা-র কপাল তো এমনিই পুড়েছে, যেটুকু বাকি ছিল – মোল্লাজি তা শেষ করে গেলেন। এরপরে যদি কাল শুনি যে, প্যাঁকালেরা ঘরগুষ্টি মিলে খ্রিস্টান হয়ে গেছে বুঁচি, তাহলে আমি কিছু বলব না।”–একটু থেমে আনসার বিষাদঘন কণ্ঠে বলে উঠল, “বুঝলি বুঁচি, প্যাঁকালের মা এত কেঁদে বেড়িয়েছে আজ, কিন্তু আজ মউলুদ শরিফ হয়ে যাওয়ার পর এবং পাড়ার মোল্লা-মোড়লদের সিদ্ধান্ত শোনার পর থেকে তার কান্না একেবারে থেমে গেছে! আহা বেচারি! ওই ছাগল কটাই তো ওর সম্বল – তাই তাকে কাল বিক্রি করতে হবে। নইলে ওর জাত যাবে পাড়ার লোকের কাছে!”

আনসার উঠে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। লতিফার চোখ-মুখের দুষ্টুমির দীপ্তি কখন ম্লান হয়ে কান্না-সজল হয়ে উঠেছিল, তা সে নিজেও টের পায়নি। হঠাৎ সে আকুল কণ্ঠে বলে উঠল, “দাদু লক্ষ্মীটি, তুমি একবার কাল মেজোবউয়ের আর মেম-সায়েবের সাথে দেখা করতে পার? তোমার ভরসা পেলে ও খ্রিস্টান থাকবে না –এ আমি জোর করে বলতে পারি। আমরা অল্পদিন হল কৃষ্ণনগর এসেছি, এর মধ্যেই ওর সাথে যে কয়টা দিন আলাপ হয়েছে, তাতে বুঝেছি – ও আর যাই হোক, খারাপ মেয়ে নয়। ও বড্ড অভিমানিনী। পাড়ার লোকের যন্ত্রণাতেই সে খ্রিস্টান হল। জানো দাদু, ও মেম-সায়েবের কাছে একটু যাওয়া-আসা করত বলে পাড়ার লোকে ওদের একঘরে করবে বলে কেবলই ভয় দেখাচ্ছিল। শেষে এমন বদনাম দিতে লাগল যে-বদনাম ওর ওপর দেওয়ার মতো মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। মানুষ দুঃখ-অভাবে পড়লে তার কি এমনই অধঃপতন হয় দাদু সকল দিক দিয়ে?…”

আনসার গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাত্রির তারা-খচিত আকাশের দিকে রইল। তার কেবলই মনে হতে লাগল – ওই রাত্রির আকাশের মতোই অসীম দুর্জ্ঞেয় রহস্য-ভরা এই পৃথিবীর মানুষ।

লতিফা চা করবার জন্য উঠে যাচ্ছিল, হঠাৎ আনসার বলে উঠল, “সত্যিই রে বুঁচি, ক্ষুধিত মানুষ – অভাব-পীড়িত মানুষের মতো সকল-দিক দিয়ে অধঃপতিত আর কেউ নয়! ক্ষুধা আছে বলেই ওরা কেবলই পরস্পরের সর্বনাশ করে। দু মুঠো অন্নের অভাবে ওদের আত্মা আজ সকল রকমে মলিন। তুই বুঝবিনে বুঁচি, ওদের অভাব কত অতল অসীম, ওদের দুঃখ কত অপরিমেয়! আমি দেখেছি, ওই হতভাগ্যদের দুর্দশার নিত্যকার ঘটনা – তাই তো আমার মুখের অন্ন এমন তেতো হয়ে উঠেছে। এক মুঠো ডাল-মাখা ভাত যখন খাই, তখন গলার ও-ধারে যেন ও আর পেরোতে চায় না, আটকে যায়! মনে হয় আকাশের ওই তারার মতোই ক্ষুধিত চোখ মেলে কোটি কোটি নিরন্ন নর-নারী আমার ওই এক গ্রাস ভাতের দিকে চেয়ে আছে! ওদের দুঃখ তুই বুঝবিনে বুঁচি। দু মুঠো অন্নের জন্য ওরা মেথর হয়ে তোদের ঘরে-বাইরের সকল রকম ময়লা-নোংরা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যায়। ধাঙড় হয়ে –ভোর না হতেই তোদের গাঁয়ের ধুলো দু মহাত দিয়ে পরিষ্কার করে পথে পথে। তাদের কথা বলিসনে বুঁচি –অন্তত ওদের দোষ দিসনে আমার কাছে কখনও! তুই তো মা, তুই কি বিশ্বাস করবি, যে ক্ষুধার জ্বালায় মা তার ছেলের হাত থেকে কেড়ে খাচ্ছে? নিজের ছেলেমেয়েকে নরবলির জন্য বিক্রি করছে দু মুটো অন্নের জন্য? খোদা তোকে সুখে রাখুন, কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা যে কী জ্বালা, তা যদি একটা দিনের জন্যও বুঝতিস, তাহলে পৃথিবীর কোনো পাপীকেই ঘৃণা করতে পারতিসনে! শুনবি একটা সত্যি ঘটনার কথা?”…

লতিফা চোখে হাত দিয়ে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, “দোহাই দাদু, তোমার দু পায়ে পড়ি, আর বোলো না। এতেই আমার দম ফেটে যাচ্ছে।”

সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে টলতে টলতে উঠে গেল।

আনসার হেসে বললে, ‘তোর সুখের অন্নকে এমন বিষিয়ে তোলা ভালো হয়নি রে বুঁচি! যাক, কাল আমি সত্যিই মেজোবউ আর মিস জোন্সের সাথে দেখা করব গিয়ে….!”

পরদিন সকাল চা খেতে খেতে নাজির সাহেব আনসারকে বলে উঠলেন, “কি হে! আজ নাকি শিকারে বেরুচ্ছ? দেখ দাদা, বাঘিনির কাছে যাচ্ছ মনে রেখ!”

আনসার হেসে বললে, “আমি শিকার করতে যাচ্ছিনে বেকুফ, আমি যাচ্ছি সুন্দরবনের বাঘকে – সুন্দরবনে ফিরিয়ে আনতে, সভ্য শিকারীর ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে।”

নাজির সাহেবও হেসে বললেন, “অন্য শিকারীর হাত থেকে বাঁচিয়ে শেষে নিজেই বাণ হেনে বোসো না। দেখো, ও বড়ো শক্ত বাঘিনি হে, শেষে বাঘিনিই তোমায় শিকার করে না ফেলে।”

আনসার লতিফার দিকে আড়-চোখে চেয়ে একটু গলা খাটো করে বললে, “রক্ষে কর ভাই, বাঘের বাচ্চা পুষবার সখ হয়নি এখনও আমার, এ আমার বাঘ শিকার নয়, এ শুধু কষ্ট স্বীকার!”

নাজির সাহেব একটু জোরেই হেসে বললেন, “তোফা! তোফা! ওগো, আর এক কাপ চা দাও তোমার রসরাজ ভাইটিকে! কিন্তু দাদা, বাঘিনির না হয় বাচ্চা আছে, কিন্তু ওই সিংহী – যে ঘরে নিয়ে গেছে?”

আনসার হেসে উঠে বলে, “ওকে সিংহী বোলো না মূর্খ, ও হচ্ছে নীলবর্ণ শৃগালিনী। হাঁ, ওর কাছে আমায় একটু সাবধানেই যেতে হবে। ওদের নখ-দন্তকে ভয় করিনে, ভয় করি ওদের ধূর্তামিকে। মিশনারির মেম!”

নাজির সায়েব ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাপ রে! মিশনারি! একে মিস, তাহে নারী! উঃ! একটা মিসফর্চুন না হয়ে যায় আজ! আই মিন ফরচুন ফর মিস!”

লতিফা ধমক দিয়ে বলে, “দোহাই! তোমার আর রসিকতা করতে হবে না! বুড়োকালে ওঁর রস উথলে উঠল! তোমার আজ হল কী বলো তো!”

আনসার হেসে বললে, “বুঝলিনে বুঁচি, ওঁর হিংসে হচ্ছে। একটুখানি মেম-সাহেবের সঙ্গে আলাপ করব গিয়ে, এ আর ওঁর সহ্য হচ্ছে না! তুই থাকতে তো ওঁর আর ওদিক পানে যাওয়ার ভরসা নেই!”

লতিফা উঠে যেতে যেতে বললে, “আমি আজই দিগ‍্‍দড়ি দিয়ে ছে্ড়ে দিতে রাজি আছি দাদা-ভাই, কিন্তু ভয় নেই, ওঁকে কেউ ছোঁবে না।”

নাজির সাহেবও উঠে যেতে যেতে বললেন, “পেতনিতে পেলে আর কেউ ছুঁতে সাহস করে!”

আনসার উঠে পড়ে বললে, “তোমরা এখন কলহ করো, আমি এখন চললাম।…”

গির্জায় গিয়ে আনসার শুনলে, মিসবাবাদের সঙ্গে দেখা করবার নিয়ম নেই। কিন্তু সে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। পাদরি সাহেবের সঙ্গে ঘণ্টা-খানিক তর্কের পর সে এই শর্তে রাজি হল যে, হেলেন ওরফে মেজোবউকে আনসার শুধু জিজ্ঞেস করবে, সে স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান হয়েছে কি-না। তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে যে মিশনারিরা ক্রিশ্চান করে নাই, এ-সম্বন্ধেও আনসার যথেচ্ছ প্রশ্ন করতে পারে। অবশ্য আনসারের খদ্দরের বহর ও তার ‘এজিটেটর’নামের জন্যই সে এই সুযোগটুকু পেল। আনসারও সাহেবদের স্পষ্টই বললে, “দেখো পাদরি সাহেব, আমি গেঁয়ো মোল্লা-মউলবি নই, যে, ধমকে তাড়িয়ে দেবে! মেজোবউ যদি স্বেচ্ছায় তোমাদের ধর্ম নিয়ে থাকে, আমি কিচ্ছু বলব না। আর যদি অন্য কোনো উপায়ে ওর সর্বনাশ করে থাক, তাহলে এই নিয়ে দেশময় একটা হইচই বাঁধিয়ে দেব।”

সাহেব একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললে, “নো মিস্টার! আপনে যঠেচ্ছ প্রশ্ন করেন আমাদের ভোগ্নি হেলেনকে, আঠাট ভূটপূর্ব মেজোবউকে। ডেখিবেন, টাহাকে স্বয়ং ঈশ্বর সটপঠে ডাকিয়াছেন! আমরা কেহ নয়!”

আনসার মনে মনে সাহেবের ‘সৎপথের’নিকুচি করে বললে, “সাহেব, এখন একটু ডাকতে পার শ্রীমতী হেলেনকে?”

সাহেব নিজে উঠে গিয়ে একটু পরেই মিস জোন্স ও মেজোবউকে নিয়ে ঘরে ঢুকল!

আনসার চেয়ার ছেড়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, “গুডমর্নিং মিস জোন্স! গুডমর্নিং মিস – আই মিন মিসেস হেলেন!”

মিস জোন্স স্মিতহাস্যে আনসারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল, কিন্তু মেজোবউ বেচারি লজ্জায় এতটুকু হয়ে আধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল! মিস জোন্সের সরোষ ইঙ্গিতেও সে কোনো রকমেই একটা নমস্কারও করতে পারল না।

মেজোবউ আনসারকে চিনত এবং একটু ভালো করেই চিনত। কতদিন দূর হতে তার দৃপ্ত চরণে তারই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করবার সময় বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখেছে। এমনি কেন যেন ওর ভালো লেগেছিল এই অদ্ভুত লোকটিকে! কতদিন সে বিনা কাজে লতিফার কাছে গিয়ে বসে থাকত এই লোকটিকে দেখবার জন্য – ওর জীবনের অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প সব শুনবার জন্য। ও যেন আলেফ-লায়লার কাহিনীর বাদশাজাদা, যেন পুথির হরমুজ, মনু-চেহের! আজ তাকেই সামনে দেখে মর্মাহত সাপিনির মতো সে কেবলই মুখ লুকাবার চেষ্টা করতে লাগল!

আনসার মেজোবউকে আবছা এক-আধটু দেখে থাকবে হয়তো! আর দেখে থাকলেও তার মনে নেই। তার কর্মময় জীবনে নারীমুখ চিন্তা তো দূরের কথা, দেখবারও ফুরসত নেই। সে জানে শুধু কার্ল-মার্কস, লেনিন, ট্রট‍্‍সকি, স্টালিন, কৃষক, শ্রমিক পরাধীনতা, অর্থনীতি। পীড়িত মানবাত্মার জন্য বেদনাবোধ ছাড়াও যে অন্যরকম মর-বেদনাবোধ থাকতে পারে – এ প্রশ্ন তার মনে জেগেছে এই সেদিন। নারীকে সে অশ্রদ্ধাও করে না, নারীর প্রতি তার কোনো আকর্ষণও নেই। নারী সম্বন্ধে সে উদাসীন মাত্র।

আজ সে মুক্তাবগুণ্ঠিতা মেজোবউকে প্রথম চোখ মেলে চেয়ে দেখল। তাকে দেখামাত্র তার হঠাৎ যেন মনে হল, এর যেন কোথায় রুবির সঙ্গে মিল আছে। রুবির কথা মনে হতেই বুকের কোনো এক কোমল পর্দায় যেন চিড় খেয়ে উঠল। আনসার কেমন যেন অসোয়াস্তি অনুভব করতে লাগল।

মিস জোন্স ইংরেজিতে বললে, “মনে হচ্ছে আপনি একে চেনেন না। চিনলে অন্যের কথা শুনে এর কাছে আসতেন না।”

আনসারও ইংরেজিতে বললে, “ওকে জানি, তবে চিনিনে সত্য। ভয় নেই, আমি ওকে ফিরিয়ে নিতে আসিনি, শুধু জানতে এসেছি, স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান হয়েছে কি-না। আশা করি, এ প্রশ্ন করলে, আপনারা ক্ষুব্ধ হবেন না।”

মিস জোন্স তারাগ্রমের ‘জি’সুরের মতো মিহিন তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠল, “কখনোই না! আপনি অনায়াসে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।”

ধন্যবাদ দিয়ে আনসার হঠাৎ প্রায়-প্রকম্বিতা মেজোবউয়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা বলুন তো আপনার হঠাৎ খ্রিস্টান হওয়ার কারণ কী?

মেজোবউ তার আনতনয়ন আনসারের মুখে তুলে ধরেই আবার নামিয়ে ফেলে বললে, “আমি তো হঠাৎ খ্রিস্টান হইনি।”

আনসার হেসে ফেলে বললে, “তার মানে, আপনি একটু একটু করে খ্রিস্টান হয়েছেন, এই বলতে চান বুঝি?”

মেজোবউ তার সেই জাদুভরা হাসি হেসে বললে, “জি না। আপনারা একটু একটু করে আমায় খ্রিস্টান করেছেন!”

আনসার বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষু মেলে এই রহস্যময়ী নারীর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে দেখল। তারপর সহানুভূতিমাখা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বুঝেছি, আমাদের ধর্মান্ধ সমাজ কত বেশি অত্যাচার করে আপনার মতো মেয়েকেও খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করেছে!”

দুঃখিনী মেজোবউয়ের দুই চক্ষু এই দুটি দরদভরা কথাতেই অশ্রুতে পুরে উঠল। একটু পরেই টসটস করে তার গণ্ড বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগল।

মিস জোন্স এবং পাদরি সাহেবের নিমেষে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। তা আনসারের নজর এড়াল না।

মিস জোন্স কিছু বলবার আগেই আনসার বলে উঠল, “ভয় করবেন না, আমি আমার হৃদয়হীন সমাজে এই ফুলের প্রাণকে নিয়ে গিয়ে শুকিয়ে মারতে চাইনে। আমার শুধু একটি অনুরোধ, একে আপনারা মানুষ করে তুলবেন, তাহলে বহু মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে এর দ্বারা।”

মিস জোন্স ও পাদরি সাহেব দুজনেই অতিমাত্রায় খুশি হয়ে বললে, “ডেখুন বাবু, ইহারই জন্যে – এই মানুষেরই মুকটির জন্যেই তো আমাদের জিশু প্রেরণ করেছেন। আপনায় ঢন্যবাড, আমরা খ্রিস্টান হওয়ার আগে ঠেকেই হেলেনকে বালো বালো কাজ শেকাচ্ছে।”

মেজোবউ হঠাৎ অশ্রু-সিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল “আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি – যদি কোনোদিন ইচ্ছে হয়?” –– বলেই সে তার অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি পূজারিনির ফুলের মতো আনসারের পানে তুলে ধরল।

আনসারের বুক কেন যেন দোল খেয়ে উঠল! এ কোন মায়াবিনী? সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “নিশ্চয়ই, যখন ইচ্ছা দেখা করবেন। আমাকে আপনার কোনো ভয় নাই। আপনার এই ধর্ম-পরিবর্তনে আমি অন্তত এতটুকু দুঃখিত নই। আপনার মতো মেয়েকে তার যোগ্যস্থান দেওয়ার মতো জায়গা আমাদের এই অবরোধ-ঘেরা সমাজে নেই। – এ আমি আপনাকে দেখে এবং দুটি কথা শুনেই বুঝেছি!” –বলেই একটু থেমে আবার বললে, “আপনি যে ধর্মে থেকে শান্তিলাভ করেন। –করুন, আমার শুধু একটি প্রার্থনা, আপনারই চারপাশের এই হতভাগ্যদের ভুলবেন না –আপনার হাত দিয়ে যদি ওদের একজনেরও একদিনের দুঃখও দূর হয় – তবে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। আপনার মতো সাহসী মেয়ে পেলে যে কত কাজই করা যায়?”

মেজোবউ তার চোখমুখ মুছে ভরা কণ্ঠে বলে, উঠল, “আমায় দিয়ে আপনার কোনো কাজের সাহায্য যদি হয় জানাবেন, আমি সব করতে পারব আপনার জন্য!” –কিন্তু ওই ‘আপনার জন্য’কথাটা বুঝি তার বেরিয়ে এসেছে। ওই কতাটা বলবার পরই তার চোখমুখ লজ্জায় রাঙা টকটকে হয়ে উঠল।

আনসারের মনে হল, সে যেন কোন নদী আর সাগরের মোহনাট উত্তাল তরঙ্গ-মধ্যে এসে পড়েছে! সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললে, “আমায় হয়তো আপনি ভালো করে চেনেন না, লতিফা আমারই বোন। যদি ওখানে কোনোদিন যান, আমার সব কথা শুনবেন। আর দেখাও ওখানেই করতে পারেন – ইচ্ছা করলে।”

মেজোবউ ঠোঁটে হাসি চেপে বলে উঠল, “আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি। আমি ওখানেই দেখা করব গিয়ে। কিন্তু যেতে দিবেন তো ওখানে খ্রিস্টাননিকে?”

আনসার কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই মেজোবউয়ের ছেলেমেয়ে দুটি কোথা থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “মা, তুই ইখেনে এয়েছিস আর আমরা খুঁজে খুঁজে মরছি!”

মেজোবউ তাদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভারি গলায় বলে উঠল, “এই দুটোই আমার শত্রু। এখানে এসে তবু দু বেলা দুটো খেতে পাচ্ছে! ওদের উপোস করা সহ্য করতে না পেরেই আমি এখানে এসেছি।”

আনসার তার বলিষ্ট বাহু দিয়ে মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েকে একেবারে তার বুকে তুলে চুমো খেতে খেতে বললে, “তোরা কী খেতে ভালোবাসিস বল তো!” দুই শিশুতে মিলে তারস্বরে যে-সব ভালো জিনিসের লিস্টি দিলে, তা শুনে ঘরের সকলেই হেসে উঠল। কিন্তু হাসলেও আনসারের এই ব্যবহার সকলের বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। অতি সামান্য ঘরের ছেলেমেয়েদের কোলে তুলে সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত যুবকের এই এত সহজভাবে চুমো খাওয়া তারা যেন দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না।

জাদুকরি মেজোবউয়ের মনে হতে লাগল, তার এতদিনের এত অহংকার আজ ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। তাকে শ্রদ্ধা করবার মতো মানুষও আছে জগতে! সে তার চেয়েও বড়ো জাদুকর। তার কেবলই ইচ্ছা করতে লাগল, দু হাত দিয়ে, এই পাগলের পায়ের ধুলো নিয়ে চোখে-মুখে মেখে ধন্য হয়, কিন্তু লজ্জায় পারল না। আর কেউ না থাকলে হয়তো সে সত্যি-সত্যিই তা করে ফেলত।

শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং তারও অতিরিক্ত কিছু সুন্দর চক্ষুকে সুন্দরতর করে তুলেছিল। তার সারা মুখে যেন কীসের আভা ঝলমল করছিল।

আনসারের দুই চক্ষুর পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে মাধুরী যেন বুভুক্ষুর মতো পান করতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই সে সচকিত হয়ে মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েদের হাতে দুটো টাকা গুঁজে বললে, “এখন আসি!” বলে সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এল।

আশ্চর্য, এবার মেজোবউও সলজ্জ হাসি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল! আনসারের উষ্ণ করস্পর্শে তার সমস্ত শরীরে যেন তড়িৎ-প্রবাহ বয়ে গেল। মনে হল, এই নিমিষের স্পর্শ বিনিময়ে সে আজ ভিখারিনি হয়ে গেল! সে তার সর্বস্ব লুটিয়ে দিল!

মিস জোন্স এবং পাদরি সাহেব এ সবই লক্ষ করছিল। এইবার পাদরি সাহেব একটু অসহিষ্ণু হয়েই মেজোবউয়ের ছেলেমেয়েকে আদেশের স্বরে বলে উঠল, “এই! টোমরা ও টাকা এখনই ফিরিয়ে ডিয়ে এসো।”

সঙ্গে সঙ্গে মেজোবউ বলে উঠল, “না, তোরা চলে আয়। তোদের ফিরিয়ে দিতে হবে না।” – বলেই ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সেও বেরিয়ে গেল।

পাদরি সাহেব বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মিস জোন্সকে ইঙ্গিতে ডেকে বহু পরামর্শের পর স্থির হল, মেজোবউকে শিগগিরই অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে।

মেজোবউ রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দেখল, একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে আনসার বিস্কুট কিনছে সামনের দোকান থেকে। সে একটু হাসল, সেই জাদুভরা হাসি। তারপর যেতে যেতে বলল, “কাল সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবেন, আমি যেমন করে পারি যাব।”

আনসার হেসে বললে, “ধন্যবাদ, মিসেস হেলেন!”

মেজোবউ তিরস্কার-ভরা চাউনি হেনে চলে গেল।

আনসারের আজ পথ চলতে চলতে মনে হল, এই ধরণির দুঃখ-বেদনা-অভাব – সব যেন সুন্দর সুমধুর! এই পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছুই নেই, ও-যেন আনন্দেরই একটা দিক। সুরার মতো এর আনন্দ তিক্ত জ্বালাময়। এ সুরা যারা পান করেছে, তাদের আনন্দ সুখী মানব কল্পনাও করতে পারে না। তার পকেট উজাড় করে সে আজ রাস্তার ছেলেমেয়েদের বিস্কুট বিলাতে বিলাতে এল। ওই ময়লা কৃষ্ণকায় ছেলেমেয়ে – ওরা ওদের সুন্দর মায়ের সন্তান। ওই যে মেয়েটা তাকে দেখে ঘোমটা দিয়ে চলে গেল, কী অপরূপ সুন্দরী সে। এই পৃথিবী যেন সুন্দরের মেলা! মনে পড়ল অমনই সুন্দর – তারও চেয়ে সুন্দর রুবিকে – মেজোবউকে।

তার দু চোখ দুই তারা – প্রভাতি তারা, সন্ধ্যাতারা – রুবি আর হেলেন, হেলেন আর রুবি!…

সে মানুষের জন্য সর্বত্যাগী হবে, সকল দুঃখ মাথা পেতে সহ্য করবে, তারা দুঃখী, তারা পীড়িত বলে নয়, তারা সুন্দর বলে। এ-বেদনাবোধ শুধু ভাবের নয়, আইডিয়ার নয়, এ-বোধ প্রেমের, ভালোবাসার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।