Skip to content

মৃত্যুক্ষুধা – পর্ব – ১৬ – কাজী নজরুল ইসলাম

চা খাওয়া হলে পর লতিফা বলে, “দাদু, তুমি তোমার ওই কাবলিওয়ালার পোশাক খুলে ফেল দেখি। কী বিশ্রী দেখাচ্ছে! মাগো! ওই ময়লা গদ্ধর পরে থাক কী করে তাই ভাবছি!

আনসার হেসে বললে, “গদ্ধর নয় রে বুঁচি, এর নাম খদ্দর। একটু থাম না তুই, তারপর দেখবি, কীরকম রাজপুত্তুরের মতো চেহারা করে ফেলি।”

বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে লাগল।

ঘণ্টা দুই পরে শেভ করে স্নান সেরে পরিষ্কার কাপড় পরে যখন আনসার বেরুল, তখন তাকে সত্যিসত্যিই রাজপুত্তুরের মতো দেখাচ্ছিল।

নাজির সাহেব ও লতিফা মুগ্ধদৃষ্টি দিয়ে আনসারকে বারে বারে দেখতে লাগল।

লতিফার ছেলেগুলি ততক্ষণে এসে বেশ করে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে। এবং আমিরের রিভলবারের আওয়াজে চাঁদ-সড়ক প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। সে বারে বারে আসে আর তার মাকে বলে, ‘বুঝলে মা, আমি এইটে নিয়ে যুদ্ধ করতে যাব। মামা আর আমি ইংরেজকে একেবারে এই গুড়ুম!’বলেই তার এবং মামার শত্রুর উদ্দেশে রিভলবারের আওয়াজ করে।

আনসার বললে, ‘বুঝলি রে বুঁচি ওই রিভলভারটা নিয়ে আজ যা করেছি ট্রেনে। এক বেটা টিকটিকি আমার পিছু নিয়েছিল আজ। শুধু আজ নয়, ওরা আছেই আমার পিছনে। রাস্তায় আমার একটি বন্ধু ছিল সাথে। মাথায় একটা হঠাৎ খেয়াল চেপে গেল। আমি বন্ধুটিকে চুপ করে বললাম, চুপি চুপি ওই টিকটিকি বাবাজিকে খবর দিতে, আমার কাছে রিভলবার আছে। সে গিয়ে খবর দিতেই, আর যায় কোথায়! দেখি, শ্রীমান রানাঘাট স্টেশনে এক ডজন কনস্টেবল নিয়ে হাজির। আমি নামতেই আমাকে বললে, ‘আপনি থানায় আসুন, আপনাকে আমাদের দরকার আছে।’আমি বললাম, ‘আমায় সেখানে চা খেতে দেবেন তো?’রেলওয়ে-পুলিশের দারোগাবাবু বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে, চা-জলখাবার সব প্রস্তুত রেখে আপনাকে নিতে এসেছি।’আমি হেসে বললাম, ‘ধন্যবাদ! চলুন!’তারপর থানায় না নিয়ে গিয়ে সার্চ করে যখন পেলে এই খেলনার রিভলবারটা, তখন তাদের মুখের অবস্থা যা হয়েছিল রে বুঁচি, তা ঠিক বলে বুঝাতে পারব না। গোবর থাকলে ছাঁচ তুলে নিতাম!” বলেই গগনবিদারী হাসি।

‍লতিফা হেসে গড়িয়ে পড়ে বললে, “আচ্ছা দাদু, তুমি এখনও ছেলেবেলাকার মতোই দুষ্টু আছ দেখছি। সে যাক, তুমি এতদিন ছিলে কোথায়, বল তো?”

আনসার হেসে বললে, “আরে, এত বড়ো খবরটাই রাখিসনে তুই? আজ আসছি ময়মনসিংহ থেকে। সেখানে এসেছিলাম সিলেট থেকে। সিলেট গেছিলাম ত্রিপুরা থেকে। কুমিল্লা গেছিলাম চাটিগাঁ থেকে।”

নাজির সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, “আরে থামো থামো, আর বলতে হবে না। বুঝেছি, টো টো কোম্পানির দলে নাম লিখিয়েছে তুমি, এই তো?”

আনসার বললে, “কতকটা তাই! তবে একেবারে বিনা উদ্দেশে নয়। ঘুরি, সাথে সাথে একটু কাজও করি।” বলেই হঠাৎ বলে উঠল, “বুঝলি রে বুঁচি, তোদের এখানে কিন্তু একদিনের বেশি থাকছিনে।”

লতিফা ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠল, “এই তিন ঘন্টার মধ্যে আমাদের এখানটা তোমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল নাকি দাদু?”

আনসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললে, “অভিমান করিসনে ভাই, সব কথা শুনলে তোরাই বাড়িতে জায়গা দিতে সাহস করবিনে।”

‍নাজির সাহেব বললেন, “জানি ভাই, তুমি দেশের কাজ নিয়ে পাগল। তা হলেও এত অল্পে আমার চাকরি যাবে না – সে ভয় তোমার করতে হবে না।”

আনসার বললে, “দাঁড়াও না একটু, এখনই থানা থেকে খবর নিতে আসবে। আমার আসবার আগেই এখানে ‘সাইফার টেলিগ্রাম’এসে গেছে যে, ১০৯ নম্বর যাত্রা করলে!”

লতিফা বলে উঠল, “১০৯ নম্বর কী দাদু?”

আনসার বললে, “ও-সব বুঝবিনে তোরা। আমাদের রাজনৈতিক অপরাধীদের একটা করে নম্বর আছে – সমস্ত সি.আই.ডি. পুলিশ অফিসারের কাছে একটা করে লিস্ট থাকে। পাছে অন্য কেউ জানতে পারে তাই আমাদের নাম না নিয়ে নম্বরটার উল্লেখ করে চিঠিপত্র লেখে বা তার করে।” –বলেই আনসার হেসে বললে, “আমাদের কি কম সম্মানরে বুঁচি! সর্বদা সাথে দুজন সশস্ত্র পুলিশ-প্রহরী। কোথাও গেলে-এলে আগেই পুলিশের অফিসার অভিনন্দিত করে স্টেশনে! তারপর দুবেলা আমাদের দিন কেমনভাবে কাটছে, তার খবর নেওয়া! একেবারে দ্বিতীয় লাট সাহেব আর কী!”

লতিফার কিন্তু কেন চোখ ছল ছল করে উঠল। আনসারের দিকে তার অশ্রুসিক্ত চোখ তুলে বললে, “তোমায় ছেলেবেলা থেকেই তো আমি জানি দাদু, তুমি চিরটাদিন এমনই পরের দুঃখে পাগল। তবু আজ কেমন ইচ্ছে করছে, আমার যদি শক্তি থাকত, তোমাকে এমন করে মরণের পথে এগুতে দিতাম না। কিছুতেই না। আচ্ছা দাদু, তোমার কীসের দুঃখ, বলতো? বাড়ি-ঘর, বিষয়-সম্পত্তি, বাপ-মা, ভাই-বোন – কিছুরই তো অভাব নেই তোমার; কিন্তু তোমায় দেখে কে বলবে, তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ আছে – তোমার ঘরবাড়ি বলতে কিছু আছে!”

আনসার বিষাদ-জড়িত কণ্ঠে বললে, “আমি তো কোনো দিন কারুর কাছে বলিনে ভাই, যে, আমার কোনো-কিছু নেই – কেউ কোথাও নেই। দুনিয়ার সব মানুষ একই ছাঁচে ঢালা নয় রে, বুঁচি। এখানে কেউ ছোটে সুখের সন্ধানে, কেউ ছোটে দুঃখের সন্ধানে। আমি দুঃখের সন্ধানী। মনে হয় যেন আমার আত্মীয়-পরিজনের কেউ নয়ই! আমার আত্মীয় যারা, তাদের সুখের নীড়ে আমার মন বসল না! আনাত্মীয়ের অপরিচয়ের দলের নীড়হারাদের সাথি আমি! ওদের বেদনায়, ওদের চোখের জলে আমি যেন আমাকে পরিপূর্ণ রূপে দেখতে পাই। তাই ঘুরে বেড়াই এই ঘর-ছাড়াদের মাঝে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।