Skip to content

দ্রোহ কথা – দেবব্রত সিংহ

দিনটা ছিল ঈদের দিন
খুশির ঈদের খুশির দিন
তখন আমার কিশোরীবেলা
তখন আমি তেরো কি চোদ্দ,
আমার ছোট কাকার মেয়ে
সে আমার থেকে অনেক বড়
দিল্লিতে কাজ করত কীসব
মাঝে সাঝে বাড়ি আসত
ঈদের দিনে সে আমাকে মেলা দেখাতে নিয়ে গেল
ক্যানিং ইস্টিশানে
সারি সারি দোকানদানি,রঙিন শাড়ি,রঙিন চুড়ি,
নতুন জামা,নতুন পোশাক,ঈদের মেলা,খুশির মেলা,
তার মাঝে ভিড় ঠেলে কোত্থেকে দিদি আমাকে
ঠান্ডা কিনে এনে খাওয়ালে
সে খাওয়ার পরই কেমন ঝিম মেরে উঠল সব
দেখতে পাচ্ছি
শুনতে পাচ্ছি
বলতে পারছি না কিছুই
দেখলাম ইস্টিশানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রেনে
তোলা হল আমাকে
তারপর আর কিছু না
তারপর ঢলে পড়েছি ঘুমে।

একসময় ঘুম ভাঙতে দেখি
আমার পাশে চারটি ছেলে
তাদের পাশে ছোট কাকার মেয়ে
তাকে দেখতে পেয়ে আমি শুধালাম,
“দিদি, আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস কোথায়?”
দিদি বলল,”তুই সবসময় দিল্লি দিল্লি করিস
তোকে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছি।”
খুব তেষ্টা পাচ্ছিল আমার
জল চাইলাম,
সে জল খেতে আবার ঝিম মেরে গেল মাথাটা
ঘুমিয়ে পড়লাম
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ট্রেনে চড়ে আরো কতদূর গেলাম কেজানে হঠাৎ ঘুমটা যখন ভাঙল
তখন দেখি মস্ত একটা বড় ইস্টিশান
পাশে তিনটে নতুন ছেলে,
“দিদি গেল কোথায়
কোথায় গেল দিদি?”
ওরা বললে,”দিদি টিদি কেউ নেই এখানে
যা বলছি শোনো
চুপচাপ নেমে এসো
কথা বলো না
আর একটাও কথা বলো না”।

জায়গাটা ইস্টিশান থেকে অনেক দূরে
শহরের পুরনো একটা ঘিঞ্জি জায়গা
সেখানে পলেস্তারা খসা চারতলা বিল্ডিং
ঘোরানো সিঁড়ি
দেখি পরপর ঘরে শুধু মেয়ে আর মেয়ে
কম বেশি আমার বয়সী সব মেয়ে
একজন মুখ টিপে হেসে বললে,”নতুন চিড়িয়া”,
সে আবার কী!
আমি হাঁ হয়ে চেয়ে রইলাম ওদের মুখের দিকে
অন্য একজন বললে,”তোর মরণ হয় না রে”,
সত্যি মরে যেতেই চাইছিলাম তখন
পরের দিন সকাল বেলা এক বয়স্কা মহিলা এলো
সে আমাকে বোঝাতে লাগলো সব
কিভাবে থাকতে হবে
কি করতে হবে আরও অনেক কিছু
সে শুনে বমি এসে গেল আমার
আমি বললাম,হবে না
ওসব আমার দ্বারা হবে না
তারপর আর কী
বোঝানোয় যখন কাজ হলো না
তখন শুরু হয়ে গেল মার
রোজদিন নিয়ম করে এলোপাতাড়ি মার
তখন ঠিকমতন খেতেও দিত না
কারো সঙ্গে কথা বলতেও দিত না
তিন মাস ধরে এরকম করে খালি পিটিয়ে গেছে
একদিন এমন মারলো যে রক্তারক্তি
অজ্ঞান হয়ে গেলাম
আমাকে ভর্তি করতে হল হাসপাতালে
অনেক ওষুধ খেলাম
স্যালাইন টানলাম
তারপর কিছুটা সুস্থ হলে ফের ওই বিল্ডিংয়ে
তারপর আমার সঙ্গে কীজানি কীভেবে
একটু ভালো ব্যবহার করতে শুরু করলে ওরা।

একদিন মন্দির দেখাতে নিয়ে গেল
একদিন বাজার ঘোরাতে নিয়ে গেল
তখন আমার মনে ঘুরতে শুরু করেছে একটা কথা
পালাতে হবে
যেভাবেই হোক পালাতে হবে এখান থেকে
ক’দিন পরে ওরা কী ভাবল জানি না
ওরা আমাকে সরিয়ে দিলে অন্য বিল্ডিংয়ে
সেটা ছিল দোতলা বিল্ডিং
মেয়েদের সংখ্যাটা আগের চেয়ে কম
তবে সেখানেও মেয়েরা সবাই বাঙালি মেয়ে
তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভাব জমে গেল আমার
আমি ওদের সময় পেলেই বোঝাতাম
“চল পালিয়ে যাই”
ওরা বলত,”পালানো অত সহজ না
ধরা পড়লে জ্যান্ত কেটে ফেলে মালকিনের লোকেরা
সেটাই নিয়মে এখানের
এভাবেই মাসছয়েক আগে একটা মেয়েকে
সবার সমুখে টুকরো টুকরো করে কেটেছে”।
আমি তবু ভয় পেলাম না
আমি তবু পালানোর কথা ছাড়লাম না।

যেসব ছেলেরা আসতো আমাদের কাছে
তাদের মধ্যে সবাই যে খুব খারাপ ছিল তা না
ভালোও ছিল
কেউ কেউ আবার জানতে চাইত
ভালোবাসতে চাইত
ভালোবাসা করে একদিন ভোরবেলায়
খুব ভোরবেলায়
দুজন ছেলে দুজন মেয়েকে নিয়ে গেল পালিয়ে
ওদের পালানো দেখে সাহস পেয়ে গেলাম আমরাও
তার ক’দিন পরে
একদিন সন্ধ্যের পর থেকে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি
মনে হল আজিই পালানোর দিন
সবচেয়ে ভালো দিন
আমি বোঝালাম আমার সঙ্গী মেয়েদের
আমরা বারো জন ছিলাম এক ঘরে
সাত জন সায় দিলে আমার কথায়
বিল্ডিংয়ের গেটে একজনা মাঝবয়সী দারোয়ান
দিনভর বসে থাকত পাহারায়
সেদিন ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় সে মদ খেয়ে বেহুঁশ
ওকে টপকে আমরা পালালাম গেট খুলে
তারপর সবাই মিলে দিলাম দৌড়
গলিটা অনেক লম্বা
গলি পেরিয়ে বড়রাস্তা
রাস্তায় ঝড়-বৃষ্টিতে অটো খুবই কম
যারা যায় তারা হাত দেখালেও থামে না
শেষে আমরা সাতজনা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম- রাস্তায়
তারপর একটা অটো আসতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম সবাই
অটোওয়ালা শুধালো,”কাহা জাওগে?”
কথাটা শুনে কী বলব কিছু খুঁজে পাইনি তখন
হঠাৎ মনে পড়ে গেছিল দেহাতিটোলার সেই ছেলেটার কথা ওখানকার মুখীয়ার ছেলে
সে বলেছিল,”কোনো বিপদে পড়লে
আমাকে একটা খবর দিও
আমি আসবো এগিয়ে”
সেদিন সেই ছেলেটা যা করেছিল
সে একেবারে দেবদূতের মতো ফেরেস্তার মতো
সে আমাদের নিয়ে তুলেছিল তার ফুপুর বাড়িতে
মালকিন কোত্থেকে খবর পেয়েছিলো কে জানে
পুলিশ পাঠিয়ে সার্চ করিয়েছিল ছেলেটার বাড়ি
ওঃ সেই দিনগুলো কী টেনশনে না কেটেছে
ট্রেন ধরতে ইস্টিশানে যাবো
সেখানেও জাল বিছিয়ে রেখেছিল মালকিনের পুলিশ
ছেলেটা কি না করেছে তখন
শেষে আমাদের সাতজনাকে সাতটা বাড়িতে রেখেছে জামাকাপড় কিনে দিয়েছে
বাড়ি ফেরার টাকা দিয়েছে
তারপর একদিন ভোররাতে অন্য একটা ইস্টিশানে
হাওড়ার ট্রেনে তুলে দিয়েছে।

তারপর বাড়ি ফেরা
বাড়ি ফিরে কদিন যেতে না যেতেই
আবার-আরেক লড়াই
কী অদ্ভুত জীবন আমাদের
কী অদ্ভুত দেশ আমাদের
পাড়ায় আমার পরে মিসিং হয়েছিল আর একটা মেয়ে
আমি ফিরে আসার পরে সেই মেয়েটার বাপ
কেস ঠুকে দিলে আমার নামে
কারণটা কী
আমি নাকি পাচার করে দিয়েছি ওর মেয়েকে
ভাবুন একবার
কোন দেশে বাস করছি আমরা ভাবুন
ক্ষমতাবান পাচারকারীরা
ক্ষমতার সঙ্গে ওঠাবসা করে
কেমন অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র গড়েছে ভাবুন
আসলে আমি গ্রামে ফিরতেই ভয় পেয়ে গেছিল ওরা
ওদের ভালোমানুষের মুখোশ খসে পড়ার ভয়
তাই গরিব ঘরের অসহায় মেয়ের বাপকে টোপ দিয়েছিল ওরা “তোমাকে কিছু করতে হবে না
যা করার সব আমরাই করব
তুমি শুধু কোর্টে দাঁড়িয়ে একবার বলে দেবে কথাটা
তারপর দেখবে তোমার পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে
আমরাই ফিরিয়ে এনে দেবো ঘরে।”

এত কাণ্ড করেও ওরা দমাতে পারেনি আমাকে
আমি আমার কাকার মেয়েকে ছেড়ে দিইনি
মামলা করেছি ওর নামে
তার সঙ্গে আড়কাঠি আর এজেন্ট দেরও বাদ দিইনি
আরও শুনবেন
আমাদের গরিব ঘরের গরিবী ঘুচাতে
চালাঘরের গায়ে মাটির দেওয়াল তুলে
ছোটখাটো একটা পোলট্রি করেছিলাম আমি
খারাপ না চলছিল ভালোই
ওরা সেসব সইতে না পেরে
একদিন এক রাতের অন্ধকারে
মুরগির খাবারে বিষ মিশিয়ে
মেরে ফেলে দিলে সব
শুধু তাই না
পোলট্রি ঘরের পাশে খড়ের ছাউনি দেওয়া
আমাদের যে মাটির ঘরটা ছিল
সেটা পুড়িয়ে দিলে আগুন দিয়ে
এখন মা’কে নিয়ে পোলট্রি ঘরেই থাকি আমি,
ক্ষমতাবানদের হাত অনেক লম্বা হয়
কথাটা শুনেছেন আপনারাও
এখন শুনে রাখুন
তার চেয়েও বেশি লম্বা পাচারকর্তাদের হাত
আমি সেই পাচারকর্তাদের বলছি
মুরগির ঘরে থাকছি বলে আমি কিন্তু মুরগি না
আমি রুবিনা বেওয়ার মেয়ে রিজিয়া
আমি লড়াইটা এত সহজে ছাড়বো না
আমরা পাচার ফেরত মেয়েরা ভয় পাই না মরতে
মরতে তো একদিন হবেই
তার আগে লড়াই করে দেখতে চাই
সবেরই একটা শেষ বলে জিনিস আছে
আমরা এর শেষ দেখতে চাই
পাচারের শেষ দেখতে চাই।।

[A]

এই কবিতা সম্পর্কে পরে কবি লিখেছেনঃ

দ্রোহকথার প্রতিটি অক্ষর প্রতিটি কথা রিজিয়ার। এখানে আমার কোন কথা নেই। সবটাই রিজিয়ার কথা। রিজিয়া নামটা কাল্পনিক। এটা ওর সত্যি নাম নয়। এই কল্পনাটুকু নিতান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে আমাকে। আমি যখন প্রথম ওর কথা শুনি ওর মুখে ওর জবানবন্দি শুনি তখনই ভেবেছিলাম এটাকে সাজিয়ে দিতে হবে কবিতায়। আমি শুধু সেই কাজটুকু করেছি। ও এখনো গ্রামে আছে দক্ষিণ 24 পরগনার একটি গ্রামে। ওকে যে লড়াই করতে হয়েছে এবং গ্রামে ফিরে আসার পরে এখনো যে লড়াই করতে হচ্ছে সেটা দুনিয়ার মানুষের জানা দরকার তার জন্য লিখেছি “দ্রোহ কথা।”এটা অন্য কিছু না রিজিয়ার অপরাজেয় জীবন সংগ্রামের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

[A]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।