Skip to content

কুহেলিকা – পর্ব – ১৮ – কাজী নজরুল ইসলাম

গাড়ি বর্ধমানে আসিয়া পঁহুচিতেই কাহাদের চঞ্চল স-বুট পদশব্দে জাহাঙ্গীরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। জাহাঙ্গীর উঠিয়া দেখিল, সকলে ঘুমাইয়া গিয়াছে। রাত্রি কতটা হইবে তাহা সে আন্দাজ করিতে পারিল না। কেবল হারুণ একাকী জাগিয়া এক মনে বোধ হয় কবিতা লিখিতেছে। একদল সশস্ত্র গোরা ও পুলিশ তাহাদের স্যালুন বারকতক প্রদক্ষিণ করিয়া স্যালুনের পূর্বের গাড়িটাতে উঠিয়া বসিল। ট্রেন ছাড়িয়া দিল।

জাহাঙ্গীরের বুঝিতে বাকি রহিল না – কোন বজ্র তাহার শির লক্ষ করিয়া ছুটিয়া আসিতেছে। সে কী করিবে, কিছুই ঠিক করিতে পারিল না। ধাক্কা দিয়া হারুণের ধ্যান ভঙ্গ করিয়া সে চুপি চুপি বলিল, ‘হারুণ, ভীষণ বিপদ! তোমায় একটা কাজ করতে হবে।’

হারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের পানে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। সে জাহাঙ্গীরের এই অহেতুক ভীতির কোনো কারণ খুঁজিয়া পাইল না।

জাহাঙ্গীর বলিল, ‘অনেকগুলো গোরা আর পুলিশ আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আাসা করছিল, দেখেছ?’

হারুণ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হাঁ!’

জাহাঙ্গীর বলিল, ‘ওরা খুব সম্ভব আমায় অ্যারেস্ট করবে। হয়তো আমাদের গাড়িও সার্চ করবে। সার্চ যদি করে – তা হলে আমরা সকলেই ভীষণ বিপদে পড়ব। তোমাকে সব কথা খুলে বলি, যাকে আমিনা বলে ভেবেছ – সে আমিনা নয় – আমাদের বিপ্লবীদলের একটি মেয়ে। ওর কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। এরা সকলেই ঘুমুচ্ছে – এই অবসরে আমি আর ওই আমিনা নেমে পড়ব স্টেশনে। তুমি আস্তে আস্তে ওর বাক্সটা নামিয়ে দেবে। কোনো ভয় কোরো না। মাকে ভাবতে মানা কোরো – আমি কালই মোটরে করে বাড়ি পঁহুচিব তোমাদের সাথে সাথে।’

হারুণ বোবার মতো বসিয়া রহিল। মনে হইল, তাহার বাক্‌শক্তি রহিত হইয়া গিয়াছে। ‘মাকে বলো – আমিনার মামা তার করায় বর্ধমান স্টেশনে তা পেয়ে আমি তাঁকে আবার অণ্ডাল পৌঁছে দিতে যাচ্ছি – তার মায়ের ভয়ানক অসুখ বেড়েছে। অণ্ডাল থেকে তার মামা এসে নিয়ে যাবেন।’

বলিয়াই সে আস্তে ধাক্কা দিয়া চম্পাকে জাগাইল। চম্পাকে কোড-ওয়ার্ডে কী কথা বলিতেই সে লাফাইয়া উঠিয়া তাহার বুকের নীচে কী পরীক্ষা করিয়া দেখিল।

তাহার পর বাক্স দুইটি আস্তে আস্তে দোরগোড়ায় টানিয়া দরজা খুলিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল। জাহাঙ্গীর আবার তাহাকে কী বলিতে সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকিয়া হিন্দু-সধবার বেশে সাজিয়া বাহির হইয়া আসিল। জাহাঙ্গীরও তাড়াতাড়ি ইউরোপিয়ান বেশে সজ্জিত হইয়া লইল। ইত্যবসরে ট্রেন শক্তিগড়ে একটু দাঁড়াইয়াই ছাড়িবার উপক্রম করিতে তাহারা ধীরে দুই জনে দুইটা বাক্স লইয়া নামিয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর চাহিয়া দেখিল, সৌভাগ্যক্রমে গোরা বা পুলিশের কেহ সেদিকে লক্ষ করিল না। তাহারা ইহাদের কলিকাতায় পাকড়াও করিবে বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া হয়তো শুইয়াছিল।

হারুণ তেমনি পাথরের মতো বসিয়া রহিল। তাহার বাক্‌শক্তি এবং নড়িবার শক্তি দু-ই যেন কে হরণ করিয়া লইয়াছে।

জাহাঙ্গীর ও চম্পা বিপরীত দিককার প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইতে বর্ধমান যাইবার ট্রেন আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন টিকিট করিবার সময় ছিল না। চম্পাকে একখানা শূন্য ফার্স্টক্লাসে তুলিয়া দিয়া সে গার্ডকে বলিয়া আসিল।

ট্রেন ছাড়িয়া দিল। চম্পা বলিল, ‘বর্ধমানে নামা হবে না। সেখানে পুলিশে নিশ্চয়ই কড়া পাহারা দিচ্ছে।’ স্থির হইল তাহারা রানিগঞ্জে নামিয়া সেখান হইতে ট্যাক্সি করিয়া কলিকাতা আসিবে। তাহা হইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা থাকিবে না।

জাহাঙ্গীর ক্লান্ত হইয়া শুইয়া পড়িল। চম্পা বলিল, ‘দাদা তোমার মাথাটা টিপে দেব?’ জাহাঙ্গীর আপত্তি করিল না। চম্পা তাহার চম্পক আঙ্গুলি দিয়া জাহাঙ্গীরের কপাল টিপিয়া দিতে দিতে বলিল, ‘দাদা তোমার মা হয়তো এতক্ষণ কী মনে করেছেন!’

জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, মা হয়তো মনে করছেন, ছেলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে উধাও হল।’

চম্পা জাহাঙ্গীরের হাতে চিমটি কাটিয়া বলিল, ‘যাও তুমি ভয়ানক দুষ্টু। আমাদের ও কথা বলতে নেই।’

জাহাঙ্গীর গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘সত্যি তাই। আমাদের যে মন্ত্রে দীক্ষা, তাতে কেউ পুরুষ-নারী বলে নেই। সেখানে সকলে অগ্নি-সখা। তা নইলে তোমার মতো রূপে-গুণে অপরূপাকে কি এত কাছে পেয়ে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতুম?’

চম্পা বলিল, ‘সত্যি তোমার সে রকম দুর্বলতা আসতে পারে বলে তুমি ভয় কর?’

জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া কহিল, ‘করি চম্পা। আমি আমাকে যত বেশি জানি, তুমি তো তা জান না।’

চম্পা ভয়ের ভান করিয়া বলিল, ‘তবে তোমার সঙ্গে আসা আমার উচিত হয়নি। অথচ প্রমতদা যাবার সময় আমায় তোমায় ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে মানা করেছিলেন। তুমি নাকি নারী জাতিটাকে ঘৃণা কর।’

জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কতকটা তাই। ওদের বিশ্বাস করি না – শ্রদ্ধা করি না বলেই আমার অত ভয়। যাকে শ্রদ্ধা করি না, তার অসম্মান করতে আমার বাধবে না।’

চম্পা প্রশ্ন করিল, ‘এই যদি তোমার মনের ভাব তা হলে বিয়ে করতে যাচ্ছ কেন এক নারীকেই?’

জাহাঙ্গীর বলিল, ‘বিয়ে করব কি-না জানিনে চম্পা, কিন্তু তার সর্বনাশের আর কিছু বাকি রাখিনি।’

হঠাৎ সাপ দেখিলে লোক যেমন চমকিয়া উঠে, চম্পা তেমনই চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘এ তুমি কী বলছ দাদা? হয় তুমি মিথ্যা কথা বলছ – কিংবা পাগল হয়েছে।’

জাহাঙ্গীর তেমনই স্থির কণ্ঠে কহিল, ‘আমি মিথ্যাও বলিনি, পাগলও হইনি চম্পা। এর পরে তোমার সাথেও হয়তো আর আমার দেখা হবে না। এই পৃথিবীর অন্তত একজন আমার বেদনার কাহিনি শুনে রাখুক – কী অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমি এসেছিলুম – কী হতে পারতুম অথচ কী হলুম।’

চম্পা কণ্ঠে বেদনা ও মিনতি ঢালিয়া দিয়া কহিল, ‘দাদা তুমি একটু শুয়ে ঘুমোও দেখি। আমি জেগে থেকে রানিগঞ্জে ট্রেন এলেই উঠিয়ে দেব। তোমার কিচ্ছু আমি জানতে চাইনে। কী হবে আমার জেনে? তোমায় দেখেছি, শ্রদ্ধা করেছি – শুধু এইটুকুই আমার যথেষ্ট।’

জাহাঙ্গীর বাধা দিয়া বলিল, ‘ না চম্পা, তোমাকে শুনতেই হবে। আমি এতদিন ভেঙে পড়িনি বা উচ্ছন্নে যাইনি প্রমতদা ছিলেন বলে। এখন আর আমার ভয় নাই। হয় স্বর্গারোহণ করব – নয় একেবারে যে পাঁক থেকে আমি উঠেছি সেই পাঁকেই ডুবে যাব।’

চম্পা প্রতিবাদের স্বরে বলিল, ‘তুমি পাঁক থেকে উঠতে পার না – যদি তা শুনেও থাক তা মিথ্যা।’

জাহাঙ্গীর ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘তুমি হয়তো আমাকে পদ্মফুল মনে করছ – তা নাকি গোবরেও ফোটে চম্পা। কিন্তু আমি যে আমাকে পরীক্ষা করে দেখেছি। তুমি শুনে আশ্চর্য হবে – সে পরীক্ষায় আমি আমার মূলের পাঁককে দেখতে পেয়েছি। আর সে পাঁক অন্যের গায়েও গিয়ে লেগেছে।’

চম্পা কী ভাবিল। তাহার পর বলিল, ‘তুমি কি ভূণীর কথা বলছ? সত্যিই কি তুমি তার ক্ষতি করেছ?’

জাহাঙ্গীর উত্তেজিত হইয়া বলিল, ‘শুধু ক্ষতি চম্পা, যে ক্ষতির চেয়ে বড়ো ক্ষতি মেয়েলোকের হতে পারে না, আমি তার সেই ক্ষতি করেছি। এক মুহূর্তের দুর্বলতাকে জয় করে উঠতে পারলাম না।’

জাহাঙ্গীরের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। সে তাহা গোপন করিবার চেষ্টা না করিয়া বলিতে লাগিল, ‘তার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত তাকে বিয়ে করা। কিন্তু সে তো জানে না – আমি আমার পিতার কামজ সন্তান, – আমার মা কলকাতার এক বিখ্যাত বাইজি! একথা জানলে সে কি আর আমায় শ্রদ্ধা করতে পারবে? আমার মূলে যদি পাঁক না থাকত, তা হলে আমি অত বড়ো পাপ করতে পারতাম? আমার প্রতি রক্ত-কণিকায় যে ভোগী পিতা বেঁচে রয়েছে – আমি ভুললেও সে আমায় যে কেবলই নরকের দিকে টানবে চম্পা! এত ঐশ্বর্য, মা যা-ই হোন তাঁর এত স্নেহ – এই নিয়ে আর যে কেউ হয়তো পরম সুখে দিনাতিপাত করতে পারত। আমি কিন্তু পিতা-মাতার অপরাধ সহস্র চেষ্টা করেও অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারলুম না। অগ্মিমন্ত্রে দীক্ষা নিলুম – ভাবলুম, আগুনে পুড়ে হয় খাঁটি হব – নয় পুড়ে ছাই হব। খাঁটি হতে পারলুম না, এখন ছাই হওয়া ছাড়া আর আমার এ জন্ম থেকে মুক্তি নেই।’ জাহাঙ্গীর হাঁপাইতে লাগিল।

আশ্চর্য! চম্পা ঘৃণায় সরিয়া গেল না। অধিকন্তু অধিকতর স্নেহে তাহার কপালের রুক্ষ চুলগুলো সরাইতে সরাইতে বলিল, ‘লক্ষ্মীটি, চুপ করে শোও। তুমিও তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ ভুল বড়ো বড়ো মহাপুরুষও করেন। যাঁদের জন্মে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করেনি, তাঁরাও তো সারা জীবন পাপে ডুবে রয়েছেন দেখছি। তোমাদের অগ্নিপন্থী দলেরই নামকরা দু-চার জনকে জানি, যারা আমার সর্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছিল। আমি ইচ্ছা করলে তাদের সর্বনাশ করতে পারতাম – করিনি, ক্ষমা করেছি। বিশেষ করে, তোমাদের অগ্নিপন্থীদের মনে যে ভীষণ পশু রয়েছে – তারই প্রেরণায় তোমরা হত্যা করতেও ভয় পাও না। সেই পশু শুধু হত্যার জন্যই নয় – অন্য কারণেও তো জেগে উঠতে পারে। তোমাদের মনের পশুকে একেবারে মেরে ফেললে তোমাদের দেবত্ব বা মনুষ্যত্ব দিয়ে আর যাই হোক – আমাদের যে মন্ত্র, যে সাধনা তার কিছু হবে না।’

জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া চম্পার দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘ চম্পা, এমন কথা তো কেউ কোনোদিন বলেনি! প্রমতদাও না।’

চম্পা বাধা দিল না তেমনিভাবে বলিতে লাগিল, ‘তবু তুমি সত্যব্রতী। তোমরা পশুকে মানুষের চামড়া পরিয়ে লুকিয়ে রাখতে জান না। অন্য যাঁদের দেখেছি, তাঁরা সমস্ত বড়ো কর্মী ত্যাগী বীরপুরুষ, কিন্তু এই সত্যটুকু স্বীকার তাঁরা করেননি। তাঁদের দুর্বলতাকে নেপোলিয়নের লাম্পট্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।’ যদিও আমি বিশ্বাস করি না – নেপোলিয়ন সেরকম ছিল।’

জাহাঙ্গীর চম্পার সেই তেজোব্যঞ্জক অপরূপ রূপমাধুরী দেখিতে দেখিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সে চম্পাকে সহসা বুকে চাপিয়া আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘চম্পা, চম্পা! আমায় বাঁচাও! হয় আমায় একেবারে রসাতলে – যে পাঁক থেকে উঠেছি সেই পাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দাও, নয় আমায় ঊর্ধ্বে নিয়ে চলো হাত ধরে।’

চম্পা রহস্য-ভরা হাসি হাসিয়া বলিল, ‘তোমায় বাধা দেব না। জানি আগুনের তৃষ্ণা কত প্রবল। কিন্তু কী হবে এ করে? আমার পিনাকীদা গেছে, মা গেছেন, প্রমতদাও গেছেন। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, বজ্রপাণির দলের হয়তো একজনও আর বাইরে নেই। আমি আজ তোমার কাছে আত্মসমর্পণ না করি, কাল করতে হবে। কারণ, তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার তো আর কোনো অবলম্বনই নাই। আমিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ – আর তোমাদেরই মতো পশুত্ব দিয়ে পশুকে জয় করার সাধনা আমার। লোভ তৃষ্ণা তোমাদের কারুর চেয়ে আমার কম নেই। কিন্তু, এর যে একটামাত্র পথ খোলা ছিল – সে পথও তো তুমিই বন্ধ করেছ!… তোমার মায়ের টাকা আছে, তুমি হয়তো বেঁচে গেলেও যেতে পার – কিন্তু তাতে আমার কী? আমি কি তোমার দেবদাসী হয়ে থাকব? জাত ধর্ম আমি মানিনে, সে শিক্ষাই পাইনি জীবনে। কিন্তু আমার নারী ধর্ম তো আছে। তাকে আজ যদি বিসর্জন দিই, কাল তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে – যেমন করে ভূণীকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ! তোমাকে বলতে আমার লজ্জা নেই – তোমাকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। তরুণ অরুণের মতো যেদিন তুমি এসে আমাদের আঙিনায় দাঁড়িয়েছিলে তোমার প্রখর দীপ্তি নিয়ে – সেইদিন থেকে তোমায় সকল প্রাণ মন দিয়ে শ্রদ্ধা করে আসছি। মরণোন্মুখ তৃষ্ণাতুর তুমি এসে দাঁড়িয়েছ – তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই – তবু ওইটুকুর বিনিময়ে আমার এমন অমূল্য শ্রদ্ধাটুকু কেড়ে নিয়ো না। তুমি ভূণীকে বিয়ে করে সুখী হও, আমি তোমাদের ভগিনীর স্নেহে সেবা করব, – যত্ন করব, তার পর মা যদি ফেরেন – মার কোলে ফিরে যাব!…’ চম্পা সহসা কাঁদিয়া ফেলিল!

জাহাঙ্গীর চম্পাকে বুকের আরও কাছে টানিয়া লইয়া আদরে অভিষিক্ত করিয়া সান্ত্বনা দিতে দিতে বলিতে লাগিল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ চম্পা। আগুনের আকুল তিয়াসা তো মিটবার নয়। তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলবে? পশুর পশু-জন্ম সার্থক হয় দেবীর বেদিতলে তার বলিদান হয়ে গেলে।… জীবনে কাউকে ভালোবাসিনি, কারুর ভালোবাসা পাইনি, আজ তাও যখন পেয়ে গেলুম দৈববলে – তখন তো আমি বেঁচে গেলুম।… আমি আমার কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি চম্পা, তোমাকে মার হাতে সঁপে দিয়ে – যে তুফান উঠেছে তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ব প্রমতদার মতো।… আমার যে ঐশ্বর্য রইল – তাতে তোমাদের এ জীবনে শান্তি ছাড়া আর কোনো কিছুর অভাব হবে না। আমি আমার সকল ঐশ্বর্য তোমায় দিয়ে যাব। তুমি আমার হয়ে ওই ঐশ্বর্য দেশ-জননীর দুঃখী সন্তান আর ভাই-বোনদের বিলিয়ে দিয়ো।’

চম্পা দুই হাতে জাহাঙ্গীরকে জড়াইয়া বালিকার মতো কাঁদিতে লাগিল। হঠাৎ যেন পাহাড় ফাটিয়া ঝরনা ধারার বাঁধ টুটিয়া গিয়াছে।

জাহাঙ্গীর ধীর শান্তস্বরে বলিতে লাগিল, ‘আমি জীবনে ভাবিনি – নারীজাতিকে কখনও শ্রদ্ধা করতে পারব – তাদের ভালোবাসতে পারব – তাদের প্রেমে বিশ্বাস করব।…. আজ আমার কাছে এই পাপের পৃথিবীও সুন্দর হয়ে উঠেছে। আমার মরুভূমির ঊর্ধ্বে মেঘের স্বপন ভেসে উঠেছে! ফুল ফুটল না সে মরুভূমিতে – দুঃখ করিনে তার জন্য। আমার চিরদগ্ধ বুক তো শীতল হল।’

সূর্যমুখী যেমন করিয়া অস্ত-সূর্যের পানে চায়, তেমনি করিয়া মুখ তুলিয়া চম্পা বলিল, ‘তোমার ঐশ্বর্যের অভিশাপ আমায় দিয়ে যেয়ো না, ও আমি সহ্য করতে পারব না। সবাই তো আমায় ছেড়ে গেল, তুমি যেয়ো না।’

জাহাঙ্গীর চম্পার চক্ষু মুছাইয়া দিতে দিতে বলিল, ‘তোমাকে তো দিয়ে যাব না ওসব চম্পা। আমার মতো যেসব যুবক দেশ-জননীর পায়ে আত্মবলি দিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে গেল, তাদের নিরন্ন মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার ব্রত হবে তোমার। তুমি হবে তাদের দেবী অন্নপূর্ণা।’

ট্রেন একটি স্টেশনে থামিতেই চম্পা বাহিরে মুখ বাড়াইয়া বলিয়া উঠি, ‘ওঠো ওঠো, রানিগঞ্জে এসে পৌঁচেছি। মাত্র দু-মিনিট স্টপেজ।’

নামিয়া ট্যাক্সি ঠিক করিতে আরও আধ ঘণ্টা কটিয়া গেল। যখন তাহারা যাত্রা করিল, তখন রাত্রি দুইটা।

মোটর চলিতে আরম্ভ করিলে জাহাঙ্গীর এলাইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আমার কী মনে হচ্ছে চম্পা, জান? যেন এ পথের আর শেষ না হয়! যুগ-যুগান্তর ধরে শুধু তোমায় পাশে নিয়ে এমনি করে ছুটে চলি।’

চম্পা কথা কহিল না। চক্ষু বুজিয়া কী যেন ভাবিতেছিল। কেহ আর কোনো কথা কহিল না। গাড়ি উল্কাবেগে ছুটিতে লাগিল, মোটর হাওড়া ব্রিজের মোড়ে আসিতেই হঠাৎ চার পাঁচজন সার্জেন্ট গাড়ি আগুলিয়া দাঁড়াইয়া মোটর থামাইবার আদেশ করিল।

জাহাঙ্গীর ও চম্পা জ্যা-ছিন্ন ধনুকের মতো সোজা হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সশস্ত্র সার্জেন্ট-দল রিভলবার হাতে লইয়া গাড়িতে ঝাঁপাইয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর পিস্তল ছুড়িতে একজন সার্জেন্ট মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। অন্য সার্জেন্ট জাহাঙ্গীরকে ধরিয়া ফেলিল।

এই ধস্তাধস্তির ফলে চম্পা কখন সরিয়া পড়িয়াছিল, কেহ টের পাইল না।

দুই তিনজন সার্জেন্ট ওই ট্যাক্সি লইয়া দুই তিন দিকে তাহার খোঁজে ধাওয়া করিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।