Skip to content

“ও বাপুন
ও বাপুন রে
আমি তোর মা রে বাপুন
আমি তোর মা
একবার চল বাপ
তোর বাবার শেষ কাজ টুকুন করবি চল”
কোনো সাড়া নেই
কোনো শব্দ নেই
শব্দ বলতে যেটুকু
সে হলো আশপাশের ভদ্রলোকদের,
একতলা দোতলা বাড়ির দুমদাম দরজা-জানলা বন্ধ করার শব্দ
রাত কিন্তু বেশি না
বড়জোর দশটা সাড়ে দশটা এরকম
উলুবেড়িয়া পুরসভার আঠাশ নম্বর ওয়ার্ডের লতিবপুরের লতুন পাড়া

খবরটা কী বাতাসে ছড়ালো
কে জানে
হলে হয়তো হতেও পারে তাই
তবু হাল ছাড়েনি মহাদেব মিস্ত্রির বউ সতীবালা দাসী
মানুষটার কিন্তু হয়নি কিছুই করোনা টরোনা কিছুই হয়নি
সত্যি বলতে কী
হওয়ার মতন তেমন কিছুই হয়নি তার
একেবারে লিকপিকে চেহারার দুবলা পাতলা মানুষ
তবে ওই চেহারাতে যা জোর ছিল সে বিশাল জোর।

বড় কোনো অসুখ বিসুখে কোনোদিন ভোগেনি সে
মাঝেসাঝে রাতবিরেতে
একটু-আধটু বুক ধড়ফড় করত এই যা
সেদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে
সে এমন হাঁচি কাশি জোটালে
সে একবার শুরু হলে চাইত না থামতে
তাই দেখে পড়শীরা বলে বেড়ালে
“করোনা হয়েছে করোনা”
একদিন দল বেঁধে বাড়ি বয়ে তারা শুনিয়ে দিয়ে গেলে
” যাই বলো আর
তাই বলো বাপু
করোনা রোগীকে ঘরে রাখাটা ঠিক না
একদম ঠিক না”
দেখেশুনে সতীবালা তাকে ভর্তি করে দিলে হাসপাতালে
ডাক্তারবাবুরা অবশ্য রাখেনি বেশিদিন
দিন দুয়েক পরেই দিয়েছিল ছেড়ে
বলেছিল, ” করোনা টরোনা
কিছু না
ব্যামোটা হল হার্টের ব্যামো কটা দিন বাড়িতে গিয়ে
বিরাম বিশ্রামে রাখো
ওষুধপাতি খাওয়াও
তারপর সময় করে আমাদের এখানে একবার দেখিয়ে নিয়ে যেও ”

সে দেখানো আর হল কই
এই সন্ধ্যা রাতে
বুক ধড়ফড় করতে করতে
চলে গেল মানুষটা।

কি আশ্চর্য দিনকাল
করোনাকালের কী আশ্চর্য দিনকাল
সতীবালা দাসীর বুকফাটা
কান্না শুনে
পড়শীরা কেউ একজনাও
এলোনা খবর নিতে
পড়শীরা কেউ একজনাও
এলো না সান্তনা দিতে
কান্না শুনে তখনই তারা
যে যার মতন
বন্ধ করে দিলে দোর ।

একলা ঘরে মরা মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে
হতবাক হয়ে বসে রইলে
সতীবালা
পাড়াপড়শি দের বিপদে -আপদে হাঁকতে ডাকতে
এককথায় ছুটে যেত মানুষটা
খেতে বসে খাবার ফেলে
কতবার গেছে ছুটে
হাসপাতালে ডাক্তার খানায় শশান ঘাটে যে যেখানে ডেকেছে ছুটে গেছে
আজ কারো দেখা নেই
আজ কারো সাড়া নেই
এসবেসটাসের ছাউনি দেওয়া
ছ’ ফুট বাই ছ’ ফুটের ঘরে
পলেস্তারা খসে পড়া বিবর্ণ দেওয়ালে টিমটিমে আলোয়
ভেসে উঠল একজনের মুখ
একমাত্র সন্তানের মুখ
বেঁচে থাকতে ওই মুখ
আর কোনদিন দেখবে না বলে
পণ করেছিল মানুষটা
লেদ কারখানার কালি ঝুলি মেখে লোহা-লক্কড়ের মেশিন চালিয়ে
দিনরাত খাটাখাটনি করে
ছেলেকে মানুষের মতন মানুষ করবে বলে
ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে
ভর্তি করে কম পয়সা ঢেলেছে
তবু তার হয়নি লেখাপড়া
বখাটে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে
তার হয়নি কিছুই
শেষমেষ বাপের অমতে
হারান মিস্ত্রির মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে
শশুরের গলায় ঝুলে পড়েছিল সে
আজ অনেক দোলাচলের পরে
আজ অনেক দোনামনার পরে
সেই ছেলের শ্বশুরবাড়ির দুয়ারে
কড়া নেড়ে একটানা ডেকে যাচ্ছে সতীবালা দাসী
” বাপুন ও বাপুন”
ডাকতে ডাকতে এক সময় থাকতে না পেরে কেঁদেও ফেলেছে
শেষে অনেক ডাকাডাকির পরে বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ছেলে বললে , ” বাবার কি থেকে কি হয়েছে
কি রোগে বাবা মারা গেছে
সেকি তুমি জানো মা
তুমি কিছুই জানো না
শোনো বাড়িতে আমার
দশ মাসের বাচ্চা
আমি পারবো না যেতে
আমি কোনমতেই যেতে পারবো না”

ছেলের কথা শুনে
স্তম্ভিত হয়ে মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে
নীরবে নিঃশব্দে ফিরে গেল মা
ছেলের কথা শুনে
চোখের জল মুছে
ক্ষোভে দুঃখে পুড়তে পুড়তে
দগ্ধ হয়ে ফিরে গেল মা ।

মাকে ফিরিয়ে দিয়ে
কি জানি কি কারণে
ছেলের কিন্তু সোয়াস্তি হলো না মনে
বউ তাকে বোঝালে বিস্তর
” তুমি যা বলেছ
একদম ঠিক বলেছ
করোনার সময় এমন বোকামি কেউ করে নাকি
বাবা হোক আর যেই হোক আগে তোমার জীবন
তারপরে অন্য কিছু”
এসব বলে টলে হাই তুলে
ঘুমিয়ে গেলে বউ
তার তবু ঘুম হলো না
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে
কিছুতেই হলো না ঘুম
বিনিদ্র চোখে চোখের পাতা বুজতেই
তাকে হাতছানি দিয়ে
ডেকে ডেকে ফিরতে লাগলো বাবা
তাকে হাতছানি দিয়ে
ডেকে ডেকে ফিরতে লাগলো ফেলে আসা শৈশব
কখনো বাবার কাঁধে রথের মেলায়
কখনো বাবার কোলে
নাগরদোলায়
কখনো পুজোর গন্ধে
নতুন জামার আনন্দে
বাবার হাত ধরে
ঠাকুর দেখতে এ পাড়া ওপাড়ায়
এসবের মাঝে এক সময়ে
শেষরাতের ফিকে অন্ধকারে
চুপি চুপি বাইরে এসে
দুয়ার খুলে বসে রইলো সে
অন্য কিছুনা
বাড়ির সমুখ দিয়ে
যে পথ গেছে চলে
সে পথ দিয়ে হাটবারে
লোকেরা যেমন হাটে যায়
তেমনি যায় শ্মশানযাত্রায়
তাই যদি দেখা যায়
দরজার আড়াল থেকে
দেখা যায় যদি একটু
শেষবারের মতন দেখা হয় যদি একবার।

দেখা অবশ্য হয়েছিল তার
তবে সে দেখা অন্য দেখা
শেষ রাতের অন্ধকারে
নক্ষত্রদের আলোয়
সে দেখেছিল
নিস্তব্ধ নির্জন পথে
বাবা মহাদেব কে কাঁধে নিয়ে
মা সতী চলেছে শ্মশানযাত্রায়
করোনাকালের মা সতী চলেছে শ্মশানযাত্রায় ।।

[A]

3 thoughts on “সতী – দেবব্রত সিংহ”

  1. অসাধারণ লাগলো ।sotti cheleo bhule gelo babar bhalobasa ,tayg .ki nisthur ei prithibi .jar jibone ei ghotona ghotbe se pagol hoye jabe.sob kichu tyag kore sontan boro kora hoy. se ki ei din dekhar jonno?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।