Skip to content

রক্তকরবী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নন্দিনী। (জানলার কাছে) শুনতে পাচ্ছ?

নেপথ্যে। কী বলতে চাও বলো।

নন্দিনী। একবার জানলার কাছে এসে দাঁড়াও|

নেপথ্যে। এই এসেছি।

নন্দিনী। ঘরের মধ্যে যেতে দাও, অনেক কথা বলবার আছে।

নেপথ্যে। বার বার কেন মিছে অনুরোধ করছ। এখনো সময় হয় নি। ও কে তোমার সঙ্গে? রঞ্জনের জুড়ি নাকি?

বিশু। না রাজা, আমি রঞ্জনের ওপিঠ, যে-পিঠে আলো পড়ে না — আমি অমাবস্যা।

নেপথ্যে। তোমাকে নন্দিনীর কিসের দরকার? নন্দিনী, এ লোকটা তোমার কে।

নন্দিনী। ও আমার সাথি, ও আমাকে গান শেখায়। ঐ তো শিখিয়েছে —

গান

“ভালোবাসি ভালোবাসি’
এই সুরে কাছে দূরে জলে-স্থলে বাজায় বাঁশি।

নেপথ্যে। ঐ তোমার সাথি? ওকে এখনই যদি তোমার সঙ্গছাড়া করি তা হলে কী হয়।

নন্দিনী। তোমার গলার সুর ও কিরকম হয়ে উঠল? থামো তুমি। তোমার কেউ সঙ্গী নেই নাকি?

নেপথ্যে। আমার সঙ্গী? মধ্যাহ্নসূর্যের কেউ সঙ্গী আছে?

নন্দিনী। আচ্ছা, থাক্‌ ও কথা। মা গো, তোমার হাতে ওটা কী?

নেপথ্যে। একটা মরা ব্যাঙ।

নন্দিনী। কী করবে ওকে নিয়ে?

নেপথ্যে। এই ব্যাঙ একদিন একটা পাথরের কোটরের মধ্যে ঢুকেছিল। তারই আড়ালে তিন হাজার বছর ছিল টিঁকে। এইভাবে কী করে টিঁকে থাকতে হয় তারই রহস্য ওর কাছ থেকে শিখছিলুম; কী করে বেঁচে থাকতে হয় তা ও জানে না। আজ আর ভালো লাগল না, পাথরের আড়াল ভেঙে ফেললুম, নিরন্তর টিঁকে-থাকার থেকে ওকে দিলুম মুক্তি। ভালো খবর নয়?

নন্দিনী। আমারও চারিদিক থেকে তোমার পাথরের দুর্গ আজ খুলে যাবে। আমি জানি, আজ রঞ্জনের সঙ্গে দেখা হবে।

নেপথ্যে। তোমাদের দুজনকে তখন একসঙ্গে দেখতে চাই।

নন্দিনী। জালের আড়ালে তোমার চশমার ভিতর দিয়ে দেখতে পাবে না।

নেপথ্যে। ঘরের ভিতরে বসিয়ে দেখব।

নন্দিনী। তাতে কী হবে?

নেপথ্যে। আমি জানতে চাই।

নন্দিনী। তুমি যখন জানবার কথা বল, কেমন ভয় করে।

নেপথ্যে। কেন।

নন্দিনী। মনে হয়, যে জিনিসটাকে মন দিয়ে জানা যায় না, প্রাণ দিয়ে বোঝা যায়, তার পরে তোমার দরদ নেই।

নেপথ্যে। তাকে বিশ্বাস করতে সাহস হয় না, পাছে ঠকি। যাও তুমি, সময় নষ্ট কোরো না। — না না, একটু রোসো। তোমার অলকের থেকে ঐ যে রক্তকরবীর গুচ্ছ গালের কাছে নেমে পড়েছে, আমাকে দাও।

নন্দিনী। এ নিয়ে কী হবে?

নেপথ্যে। ঐ ফুলের গুচ্ছ দেখি আর মনে হয়, ঐ যেন আমারই রক্ত-আলোর শনিগ্রহ ফুলের রূপ ধরে এসেছে। কখনো ইচ্ছে করছে, তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলি, আবার ভাবছি, নন্দিনী যদি কোনোদিন নিজের হাতে ঐ মঞ্জরি আমার মাথায় পরিয়ে দেয়, তা হলে —

নন্দিনী। তা হলে কী হবে?

নেপথ্যে। তা হলে হয়তো আমি সহজে মরতে পারব।

নন্দিনী। একজন মানুষ রক্তকরবী ভালোবাসে, আমি তাকে মনে করে ঐ ফুলে আমার কানের দুল করেছি।

নেপথ্যে। তা হলে বলে দিচ্ছি, ও আমারও শনিগ্রহ, তারও শনিগ্রহ।

নন্দিনী। ছি ছি, ওকি কথা বলছ! আমি যাই।

নেপথ্যে। কোথায় যাবে?

নন্দিনী। তোমার দুর্গদুয়ারের কাছে বসে থাকব।

নেপথ্যে। কেন।

নন্দিনী। রঞ্জন যখন সেই পথ দিয়ে আসবে, দেখতে পাবে আমি তারই জন্যে অপেক্ষা করে আছি।

নেপথ্যে। রঞ্জনকে যদি দলে ধুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিই, আর তাকে একুটও চেনা না যায়।

নন্দিনী। আজ তোমার কী হয়েছে। আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছ কেন।

নেপথ্যে। মিছিমিছি ভয়? জান না, আমি ভয়ংকর?

নন্দিনী। হঠাৎ তোমার এ কী ভাব! লোকে তোমাকে ভয় করে এইটেই দেখতে ভালোবাস? আমাদের গাঁয়ের শ্রীকণ্ঠ যাত্রায় রাক্ষস সাজে– সে যখন আসরে নামে তখন ছেলেরা আঁতকে উঠলে সে ভারি খুশী হয়। তোমারও যে সেই দশা। আমার কী মনে হয় সত্যি বলব? রাগ করবে না?

নেপথ্যে। কী বলো দেখি।

নন্দিনী। ভয় দেখাবার ব্যাবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না!

নেপথ্যে। কী বলছ, নন্দিনী?

নন্দিনী। এতদিন যাদের ভয় দেখিয়ে এসেছ তারা ভয় পেতে একদিন লজ্জা করবে। আমার রঞ্জন এখানে যদি থাকত তোমার মুখের উপর তুড়ি মেরে সে মরত, তবু ভয় পেত না।

নেপথ্যে। তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। এতদিন যা-কিছু ভেঙে চুরমার করেছি তারই রাশকরা পাহাড়ের চূড়ার উপরে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করছে। তার পরে–

নন্দিনী। তার পরে কী?

নেপথ্যে। তার পরে আমার শেষ ভাঙাটা ভেঙে ফেলি। দাড়িমের দানা ফাটিয়ে দশ আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে যেমন তার রস বের করে, তেমনি তোমাকে আমার এই দুটো হাতে– যাও যাও, এখনই পালিয়ে যাও, এখনই।

নন্দিনী। এই রইলুম দাঁড়িয়ে। কী করতে পার করো। অমন বিশ্রী করে গর্জন করছ কেন।

নেপথ্যে। আমি যে কী অদ্ভুত নিষ্ঠুর, তার সমস্ত প্রমাণ তোমার কাছে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আমার ঘরের ভিতর থেকে কখনো আর্তনাদ শোন নি?

নন্দিনী। শুনেছি, সে কিসের আর্তনাদ?

নেপথ্যে। সৃষ্টিকর্তার চাতুরী আমি ভাঙি। বিশ্বের মর্মস্থানে যা লুকোনো আছে তা ছিনিয়ে নিতে চাই, সেই-সব ছিন্ন প্রাণের কান্না। গাছের থেকে আগুন চুরি করতে হলে তাকে পোড়াতে হয়। নন্দিনী, তোমার ভিতরেও আছে আগুন, রাঙা আগুন। একদিন দাহন করে তাকে বের করব, তার আগে নিষ্কৃতি নেই।

নন্দিনী। কেন তুমি নিষ্ঠুর?

নেপথ্যে। আমি হয় পাব, নয় নষ্ট করব। যাকে পাই নে তাকে দয়া করতে পারি নে। তাকে ভেঙে ফেলাও খুব একরকম করে পাওয়া।

নন্দিনী। ও কী, অমন মুঠো পাকিয়ে হাত বের করছ কেন।

নেপথ্যে। আচ্ছা, হাত সরিয়ে নিচ্ছি। পালাও তুমি, পায়রা যেমন পালায় বাজপাখির ছায়া দেখে।

নন্দিনী। আচ্ছা যাই, আর তোমাকে রাগাব না।

নেপথ্যে। শোনো শোনো, ফিরে এসো তুমি। নন্দিনী! নন্দিনী!

নন্দিনী। কী, বলো।

নেপথ্যে। সামনে তোমার মুখে-চোখে প্রাণের লীলা, আর পিছনে তোমার কালো চুলের ধারা মৃত্যুর নিস্তব্ধ ঝরনা। আমার এই হাতদুটো সেদিন তার মধ্যে ডুব দিয়ে মরবার আরাম পেয়েছিল। মরণের মাধুর্য আর কখনো এমন করে ভাবি নি। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুলের নীচে মুখ ঢেকে ঘুমোতে ভারি ইচ্ছে করছে। তুমি জানো না, আমি কত শ্রান্ত।

নন্দিনী। তুমি কি কখনো ঘুমোও না।

নেপথ্যে। ঘুমোতে ভয় করে।

নন্দিনী। তোমাকে আমার গানটা শেষ করে শুনিয়ে দিই–

“ভালোবাসি ভালোবাসি’
এই সুরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাজায় বাঁশি।
আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় গো ভাসি।

নেপথ্যে। থাক্‌ থাক্‌, থামো তুমি, আর গেয়ো না।

নন্দিনী।

সেই সুরে সাগরকূলে
বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে
অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন হাসি।

পাগলভাই, ঐ-যে মরা ব্যাঙটা ফেলে রেখে দিয়ে কখন পালিয়েছে। গান শুনতে ও ভয় পায়!

বিশু। ওর বুকের মধ্যে যে বুড়ো ব্যাঙটা সকলরকম সুরের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আছে, গান শুনলে তার মরতে ইচ্ছে করে। তাই ওর ভয় লাগে। — পাগলি, আজ তোর মুখে একটা দীপ্তি দেখছি, মনের মধ্যে কোন্‌ ভাবনার অরুণোদয় হয়েছে আমাকে বলবি নে?

নন্দিনী। মনের মধ্যে খবর এসে পৌঁচেছে, আজ নিশ্চয় রঞ্জন আসবে।

বিশু। নিশ্চয় খবর এল কোন্‌ দিক থেকে।

নন্দিনী। তবে শোনো বলি। আমার জানলার সামনে ডালিমের ডালে রোজ নীলকণ্ঠপাখি এসে বসে। আমি সন্ধে হলেই ধ্রুবতারাকে প্রণাম করে বলি, ওর ডানার একটি পালক আমার ঘরে এসে যদি উড়ে পড়ে তো জানব, আমার রঞ্জন আসবে। আজ সকালে জেগে উঠেই দেখি উত্তরে হাওয়ায় পালক আমার বিছানায় এসে পড়ে আছে। এই দেখো আমার বুকের আঁচলে।

বিশু। তাই তো দেখছি, আর দেখছি কপালে আজ কুঙ্কুমের টিপ পরেছ।

নন্দিনী। দেখা হলে এই পালক আমি তার চূড়োয় পরিয়ে দেব।

বিশু। লোকে বলে নীলকণ্ঠের পাখার জয়যাত্রায় শুভচিহ্ন আছে।

নন্দিনী। রঞ্জনের জয়যাত্রা আমার হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে।

বিশু। পাগলি, এখন আমি যাই আমার নিজের কাজে।

নন্দিনী। না, আজ তোমাকে কাজ করতে দেব না।

বিশু। কী করব বলো।

নন্দিনী। গান করো।

বিশু। কী গান করব?

নন্দিনী। পথচাওয়ার গান।

বিশু।

গান

যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে।
সেই বুঝি মোর পথের ধারে রয়েছে বসে।
আজ কেন মোর পড়ে মনে কখন্‌ তারে চোখের কোণে
দেখেছিলেম অফুট প্রদোষে।
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে!
আজ ওই চাঁদের বরণ হবে আলোর সংগীতে,
রাতের মুখের আঁধারখানি খুলবে ইঙ্গিতে।
শুক্ল রাতে সেই আলোকে দেখা হবে, এক পলকে
সব আবরণ যাবে যে খসে।
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে।

নন্দিনী। পাগল, যখন তুমি গান কর তখন কেবল আমার মনে হয় অনেক তোমার পাওনা ছিল, কিন্তু কিছু তোমাকে দিতে পারি নি।

বিশু। তোর সেই কিছু-না-দেওয়া আমি ললাটে পরে চলে যাব। অল্প-কিছু-দেওয়ার দামে আমার গান বিক্রি করব না। — এখন কোথায় যাবি?

নন্দিনী। পথের ধারে, যেখান দিয়ে রঞ্জন আসবে। সেইখানে বসে আবার তোমার গান শুনব।

[উভয়ের প্রস্থান]

পরবর্তী অংশ

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।