Skip to content

মৃত্যুক্ষুধা – পর্ব – ২৮(শেষ) – কাজী নজরুল ইসলাম

ভাই বুঁচি,

আমি যদি আজ আমার পরিচয় দিই-আমি তোদের সেই রুবি, তাহলে বিশ্বাস করবি? আমার বাপ মাও জানেন আর তোরাও হয়তো জানিস, আমি মরেছি! অথবা যদি না মরে থকি, তাহলে আমার মরণই মঙ্গল বা একমাত্র গতি!

তোরা – অন্তত তুই শুনে সুখী হবি, না দুঃখিত হবি জানিনে, যদি আমি লিখি যে, আমি আজও মরিনি। আমি বেঁচে গেছি বুঁচি, বেঁচে গেছি – তোদের চেয়েও বড়ো করে বেঁচে গেছি।

আজ তোকে সব কথা বলব খুলে, “তারপর সামনে রয়েছে কূলহারা সমুদ্র। কূলহারা জীবনকে আর কেউ নিতে না পারে, সে তো রয়েছে!

তোর কাছে যখন জানালাম, তোর আনু ভাই রেঙ্গুন জেল থেকে মৃত্যুর নোটিশ হাতে ওয়ালটেয়ারে যাচ্ছে, তখনই আমার কর্তব্য ঠিক করে ফেললাম। তোর-কাছে-লেখা তার চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল, “তোমায় চায়, সে তোমায় চায়!” রাজার লাঞ্ছনা-তিলক তার কপালে, শ্যাম সমান মরণের বাঁশি তার হাতে, ওই যে রাজপুত্র! আমি অভিসারে বেড়িয়ে পড়লাম।

আমি জানতাম, আমার বাপ-মার অদেশ-অনুরোধ ও স্নেহের বিপুল বাধাকে ডিঙিয়ে কিছুতেই বুঝি তার সান্নিধ্য লাভ করতে পারব না। কিন্তু সে যখন তার মৃত্যু-মলিন চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকাল, তখন তার কাছে আমার সম্মুখের এত বড়ো বাধা যেন বাধা বলেই মনে হল না।

মনে হল এত বড়ো যে বাধা, এর বড়ো যে অন্তরায় – সে তার চেয়েও বড়ো, তার চেয়েও বিপুল! আকাশ ডাক দিল, আমার পাখা চঞ্চল হয়ে উঠল, আমি নীড়ের মায়া ভুললাম।

যে পর্বতে জন্মগ্রহন করেছি আমি স্রোতস্বিনী, তার এত পাথর এত বন-জঙ্গল পথ আগলে আমায় ধরে রাখতে পারলে না, আমি সমুদ্রের উদ্দেশে ছুটে এলাম। সমুদ্রের নাগাল পেয়েছি, আজ আমার মনে হচ্ছে, এই আমার শেষ, এই আমার পরিণতি, এই আমার সার্থকতা। কূল হারিয়েছে অকূলের বন্ধুকে পেলাম।

আমার বাপ-মার মনে – তোদের মনে কত ব্যথা দিয়েছে জানি। তোরা পাহাড়ের মতো সংস্কারের পর সংস্কারের পাথর চড়িয়ে উঁচু হয়ে আছিস, তোরা হয়তো তাকেই বলিস মহিমা। কিন্তু ওই মহিমার অচলায়তনে নিশ্বাস রোধ করে বেঁচে থাকার মায়া অন্তত আমার ছিল না কোনোদিন। ও জীবন আমার নয়। নিজেকে হারিয়ে দেওয়া, ছড়িয়ে দেওয়াই আমার জীবনের গতি। পথে চলে, ভুল করে, পথ হারিয়েই আমার মুক্তি। জানি, ও জীবন আমার কাছে যেমন সত্য, তোদের কাছে তেমনই মিথ্যা।

আমার সত্যকে আমি চেয়েছি এবং পেয়েওছি – এই আমার সান্ত্বনা!…

একদিন অন্ধকার রাত্রে – যখন তোরা, আত্মীয়-স্বজন সবাই ঘুমুচ্ছিলি, আমি বেড়িয়ে পড়লাম অন্ধকারের হাত ধরে। আলোর দেশে পৌঁছে দিয়ে আমার সাথি অন্ধকার চলে গেছে! আমি আলো পেয়েছি, বন্ধুকে পেয়েছি – আমাকে পেয়েছি।

তোর চেয়ে তো বড়ো আত্মীয় আনসারের কেউ নেই, কই, তুই তো এমন করে আসতে পারলিনে!

আমি কে তার? দু-দিনের পরিচয় – কৈশোরের স্বপ্ন! কিন্তু সে-স্বপ্নের নেশা আর আমার কাটল না। সেই স্বপ্নের পরিচয়কে সকলের মাঝে স্বীকার করার অবকাশ বিধাতা দিলেন না। আমাদের শুভদৃষ্টি হল সকলের অন্তরালে – মৃত্যু আর সমুদ্রকে সাক্ষী করে। আমাদের বাসর সাজাচ্ছে মৃত্যু তার অন্ধকারের নীলপুরীতে! বাইরে কেবল কোলাহল, কেবল লজ্জা, ভালো করে চোখ চেয়ে বন্ধুকে দেখবার অবকাশ নেই। এইবার দেখব তাকে সেই বাসর-ঘরে চোখ পুরে প্রাণ পুরে। রবি-শশী-গ্রহ-তারার দল আমাদের বাসর-ঘরে আজ থেকেই আড়ি পাতছে।…

এখানে এসে একদিন কাগজের দেখলাম, আমার বাবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করছেন। আমি কি বুঝি না, কেন তিনি অবসর গ্রহণ করলেন – শুধু চাকরিতে নয়, হয়তো বা জীবনেও! সব বুঝি, তবু এর আর কোনো চারা ছিল না!

মনে করলাম, ভালোই হল এ। যে ক্ষমা এ জীবন পাব না বাবার কাছে, সে ক্ষমা চেয়ে নেব এর পরের জীবনে। সেখানে সংস্কারের বন্ধন নেই, মহিমার উচ্চতা নেই, প্রেস্টিজের অভিমান নেই। মৃত্যুর বাসর-ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁর পায়ের ধূলো নেব, আমি জানি – সেদিন প্রাণ ভরে তিনি আশীর্বাদ করবেন!

আর মা? আজ যদি যাই তাঁর কোলে ফিরে, আজও তিনি ধুলো মুছে তেমনি করে বুকে তুলে নেবেন। কিন্তু মা তো বাবাকে ছাড়িয়ে নেই। যে ক্ষমা বাবা এ জীবনে করতে পারবেন না, বুক ফেটে গেলেও না, মা সে-ক্ষমার বাণী উচ্ছারণ করতে পারবেন না! তাঁরা রটিয়েছেন, মেয়ে মরে গেছে। সেইটেই সত্য হোক!

আমার জন্য যে মিথ্যা কবর খোদাই হয়েছিল, সে-শূন্য থাকবে না। আমি তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব – যত তাড়াতাড়ি পারি মরে তাঁদের সকল লজ্জার অন্ত করব।

অবশ্য আত্মহত্যা করে নয়! এ ভীরুতা আমার মনে কোনো দিনই নেই। থাকলে অনেক আগেই মরতে পারতাম –অন্তত সেইদিন, যেদিন আমার অমতে আমাকে বিয়ের ছুরিতে গলা রাখতে হয়েছে।

এ তো গেল আমার দুঃখের কাহিনি। এইবার আমার সুখের কথা শুনবি?

আমি যখন ওয়ালটেয়ারে এসে নামলাম, দেখি আনসারের রাজ-বন্ধু পুলিশের গুপ্তচর আমায় ছেয়ে ফেলেছে। আমার শাপে-বর হল! কত সন্ধান করে তবে হয়তো তাকে বের করতে হত। তাদের কাছেই সন্ধান পেলাম, অবশ্য আমার জিনিসপত্র সন্ধান করতে দেওয়ার বিনিময়ে।

তখনও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেনি। তার শিয়রে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটি ছোট ঘরে অলসভাবে হাত দুটি এলিয়ে দিয়ে সে সন্ধ্যাতারার দিকে চেয়ে আছে।

আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছিলাম জুতা খুলে। দেবতার ঘরে কি জুতা পরে ঢুকতে আছে?

দেখলাম, বেলাশেষের পুরবি রাগিণীর মতো তার চোখে-মুখে কান্না আর ক্লান্তি। বাতায়নপথে সন্ধ্যাতারার দিকে সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সে নিঃশব্দে সন্ধ্যাতারাকে নমস্কার করলে। আমি অমনই ঘুরে ঢুকে বললাম, “আমি এসেছি।”

সে কী আনন্দ তার চোখে-মুখে ! সে ‘রুবি’বলে ডেকেই মূর্ছিত হয়ে পড়ল।…

আচ্ছা বুঁচি, তুই ঘুমন্ত ক্ষুধাতুর অজগরের জাগরণ দেখছিস? শিউরে উঠিসনে। সব কথা ভালো করে শোন।

দুদিন না যেতেই বুঝলাম, ক্ষুধিত অজগর জেগে উঠেছে। ওর সে বিপুল আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য কী বন-হরিণীর?

সে আমায় তিলে তিলে গ্রাস করতে লাগল। আমি কাঁদতে লাগলাম, আমার জন্য নয় – ওর জন্য। এ -সর্বগ্রাসী ক্ষধা যে শুধু আমার মৃত্যু নয় – এ যে ওরও মৃত্যু! ও যে মৃত্যু-জরজর, আমাকে গ্রাস করে বেঁচে থাকার ক্ষমতা কি আজ আর ওর আছে?

আমি জানতাম এ-রোগের বড়ো শত্রু ওই প্রবৃত্তি! নইলে, যে আনসারের সংযম তপস্বীর চেয়েও কঠোর, তাকে এ মৃত্যু-ক্ষুধায় পেয়ে বসল কেন?

সে যখন বলল, “রুবি, চিরদিনই বিষ খেয়ে বড়ো হয়েছি, আজ মৃত্যুর ক্ষণে তুমি অমৃত পরিবেশন করো! আমি মৃত্যুঞ্জয়ী হই।”

আমি আমার উপবাসীর ভিখারী কে ফেরাতে পারলাম না।

তবু ডাক্তারকে জিঞ্জাসা করলাম, “ওকে কি বাঁচাতে পারবেন বলে মনে হয়?”

ডাক্তার বলল, “ওঁর একধারের ফুসফুস খেয়ে ফেলেছে। আর এক ধারও আক্রমণ করেছে। ও রোগ এখন আমাদের চিকিৎসার শক্তিকে অতিক্রম করে গেছে, এখন ওঁকে যদি বিধাতা বাঁচান!”

আমি ডাক্তার কে নমস্কার করে বললাম, “তাহলে আপনার আর কষ্ট করে আসবার দরকার নেই ডাক্তার সাহেব। ও শান্তিতে মরুক!”

ডাক্তার চলে গেল। আমিও আমার কর্তব্য বেছে নিলাম।

আমি পরিপূর্ণরূপে তার ক্ষুধিত-মুখে আত্মসমর্পণ করলাম! যদি ও না-ই বাঁচে, তবে ওকে ক্ষুধা নিয়ে মরতে দেব না, দুদিন আগে মরবে এই তো; তাছাড়া এ মৃত্যু তো ওর একার নয়, ওর বুকের মৃত্যু-বীজানু আমাকেও তো আক্রমণ করবে!

সে কী তৃপ্তি, সে কী আনন্দ ওর! মরুপথের পথিক মরবার আগে যেন মরূদ্যানের ছায়া পেল!

ওর আনন্দ, ওর হাসি, ওর সুখ দেখে মনে হল, ও বুঝি বেঁচে গেল! বিষই বুঝই ওর বিষের ওষুধ হল!

কিন্তু – কিন্তু – বুঁচি! লতি! সই! আজ আমার ঘরের প্রদীপ নিবে আসছে! তার শিখা কাঁপছে! মরণের ঝড় আমার ঘরে ঢুকে মাতামাতি করছে। আমি আমার এইটুকু আঁচলের আড়াল দিয়ে ওকে বাঁচাই কী করে ভাই?

কে জানত, ওর ওই হাসি, ওই আনন্দ – নিভবার আগে শেষ জ্বলে ওঠা!

চিঠি লিখতে লিখতে ভোর হয়ে এল! তারই শিয়রে বসে এই চিঠি লিখছি। আমাদের শিয়রের বাতি নিভে আসছে। সে একদৃষ্টে ভোরের তারার দিকে তাকিয়ে আছে! কথা বন্ধ হয়ে গেছে কাল থেকেই। কাউকে আমি ডাকিনি। সেও ডাকেনি।

দুইজনে সারারাত সমুদ্র আর আকাশের তারা দেখেছি।

একবার শুধু অতিকষ্টে বলেছিল, “ওই তারার দেশে যাবে?”

আমি বললাম, ‘যাব।’সে গভীর তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বললে, “তাহলে এসো, আমি তোমার আশায় দাঁড়িয়ে থাকব!”

তারপর আমায় চুমু খেল।

এক ঝলক রক্ত উঠে এল! তার বুকের রক্তে আমার মুখ-ঠোঁট রাঙা হয়ে গেল।

আশীর্বাদ করিস, এই রক্ত-লেখা যেন আর না মোছে!…

তোর কাছে যখন এই লিপি গিয়ে পৌঁছবে – ততক্ষণে আমার দীপ নিভে যাবে! আমার সুন্দর পৃথিবী – আমার চোখে মলিন হয়ে উঠেছে! আমার চোখের নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে!

আমি জানি, আমারও দিন শেষ হয়ে এল! আমিও বেলাশেষের পুরবির কান্না শুনেছি। আমার বুকে তার মৃত্যু-বীজাণু নীড় রচনা করেছে! আমার যেটুকু জীবন বাকি আছে তা খেতে তাদের আর বেশিদিন লাগবে না। তারপর চিরকালের চিরমিলন–-নতুন জীবনে–নতুন তারায়–নতুন দেশে – নতুন প্রেমে!

তোদের সকলের জন্যে সে কেঁদেছে। কত বড়ো, কত বিপুল জীবন নিয়ে সে জন্মেছিল – আর কী দুঃখ নিয়েই না সে গেল! রাজার ঐশ্বর্য নিয়ে সে এসেছিল – সে গেল ভিখারির মতো – নিরন্ন, নিঃসহায়, নির্বন্ধু –একা!

সে বলে গেছে, মৃত্যুর পর তার দেহ মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে। সমুদ্রকে সে ভালোবেসেছিল – বুঝি বা আমার চেয়েও। সাগরের মতো প্রাণ যার – তাকে সাগরের জলেই ভাসিয়ে দেব।

আর আমার সময় নেই! আমারও প্রদীপ নিবে এল বল।

–রুবি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।