Skip to content

কুহেলিকা – পর্ব – ১৬ – কাজী নজরুল ইসলাম

সকালে উঠিয়া ভূণীর মনে হইল, তাহার সকল দর্পের অবসান হইয়াছে। আজ সে পথের ভিখারিনি। দুই হাত পাতিয়া এখন তাহাকে ভিক্ষার তণ্ডুলকণা গ্রহণ করিতে হইবে। কালও সে মনে করিয়াছিল, যত বড়ো দরিদ্র হোক তাহারা, তবু সে দেখাইয়া দিবে – আত্মসম্মান শুধু ধনীরই একচেটিয়া নয়। দারিদ্রের কঠিন দর্প দিয়াই সে ধনীর ঐশ্বর্যকে অতি বড়ো আঘাত করিবে।

আজ কিন্তু তাহার মনে হইতে লাগিল, আঘাত তো সে আর করিতেই পারিবে না, উলটো যত আঘাতই আসুক, – তাহাকে পড়িয়া পড়িয়া তাহা সহিয়া যাইতে হইবে।

হারুণ ফিরদৌস বেগম সাহেবার তার পাইয়া তাহার বাবাকে জানাইবামাত্র – তিনি আনন্দে আত্মহারা হইয়া বলিয়াছিলেন, ‘বাবা, এতদিনে খোদা মুখ তুলে চেয়েছেন!’ ভূণীর মাথায় হাত রাখিয়া অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, ‘রাজরানি হয়ে আমাদের ভুলে যাসনে মা!’

ভূণী কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলিয়াছিল, ‘তাঁরা নিতে এলেও আমি তোমায় ছেড়ে যাব না তো বাবা!’

পিতা বুঝিতে না পারিয়া বলিয়াছিলেন, ‘সে কী মা! হাতের লক্ষ্মীকে কি পায়ে ঠেলতে হয়? অতবড়ো জমিদারি, বেগম নিজে আমার বাড়ি আসছেন – এ কী আমার কম সৌভাগ্য?’

ভূণী রাগ করিয়া বলিয়াছিল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ বাবা, আমার বাপ দাদার আজ অর্থ না থাকলেও বংশ-গৌরবে তাঁরা তাঁদের চেয়ে অনেক বড়ো। বাড়ি বয়ে তাঁরা তাঁদের ঐশ্বর্যের দর্প দেখাতে আসবেন, এ তোমরা সইলেও আমি সইতে পারব না।’

জাহাঙ্গীরের মাতার প্রাণঢালা স্নেহ-আদরে তাহার কঠিন অভিমানের আবরণ টুটিয়া পড়িয়াছিল, তবু সে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের কথা ভাবিতেই পারে নাই।

কিন্তু কী করিতে কী হইয়া গেল! কেন সে দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে কাঁদিয়া ফেলিল।

মোমি ব্যতীত তখনও কেহ জাগিয়া উঠে নাই। তহমিনা উঠিতে গিয়াও যেন উঠিতে পারিল না। তাহার বুকে-শরীরে ভীষণ ব্যথা। শুইয়া শুইয়াই দেখিল, জাহাঙ্গীরের মাতা তাহাদের ঘরের দাওয়ায় মাটিতে বসিয়া পড়িয়া কোরান ‘তেলাওত’ করিতেছেন।

অপূর্ব ভক্তি-মধুর সে কণ্ঠস্বর! তাহার এক বর্ণও সে বুঝিতে পারিতেছিল না। কিন্তু কেমন এক অজানা শ্রদ্ধায় তাহার মন ভরিয়া উঠিল। তাহার মনের অর্ধেক গ্লানি যেন কাটিয়া গেল।

সে চেষ্টা করিয়া উঠিয়া পড়িল।

জাহাঙ্গীরের মাতা কোরান তুলিয়া রাখিয়া বলিলেন, ‘উঠেছ মা সোনা! এ কী? তোমার চোখ মুখ অমন হয়ে গেছে কেন মা? অসুখ করেছে বুঝি?’

তহমিনার মনে হইল, তাহাকে দেখিয়াই বোধ হয় মাতা সব বুঝিতে পারিয়াছেন। সে লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিল, ‘জি, না।’

জাহাঙ্গীরের মাতা তাহাকে বক্ষে টানিয়া ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘বালাই! এমন বদ-খেয়ালি কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় মা। – তোমার মা কখন উঠবেন? তাঁহাকে যে দেখলুমই না!’

তহমিনার কিছু বলিবার আগেই মোমি বলিয়া উঠিল, ‘মা যে পাগল। মা উঠলেই তো কাঁদতে শুরু করবে বড়ো ভাইয়ের নাম করে!’

জাহাঙ্গীরের মাতা সব শুনিয়াছিলেন। তাঁহার চক্ষে জল আসিল। মোমিকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোমার মা ভালো হয়ে যাবেন মা। আমরা তোমার মাকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাব। আর, যদ্দিন তোমার মা ভালো হয়ে না উঠেন, তদ্দিন আমি হব তোমার মা, কেমন?’

কলিকাতা যাওয়ার কথায় মোমি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল। সে কলিকাতা সম্বন্ধে তাহার দাদাভাই-এর কাছে কিছু কিছু গল্প শুনিয়াছিল। সে কলকাতা সম্বন্ধে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করিতে লাগিল। জাহাঙ্গীরের মাতা হাসিয়া সে সবের উত্তর দিতে লাগিলেন।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে জাগিয়া উঠিল। গ্রামে বেগম আসিয়াছে বলিয়া হইচই পড়িয়া গেল। ঘরে মেয়েদের ভিড় লাগিয়া গেল।

জাহাঙ্গীরের মাতা বা দেওয়ান সাহেব বিবাহের কোনো কথাই তুলিলেন না।

জাহাঙ্গীরের মাতা হারুণের পিতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘আপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাইতে এসেছি! অবশ্য ছেলের বন্ধুর বাড়ি দেখতে আসাও আমাদের এখানে আসার আর একটা কারণ। আমি পশ্চিমবঙ্গের পল্লিগ্রাম কখনও দেখিনি – এই অবসরে তাও দেখা হয়ে গেল।’

হারুণের পিতা বিনয়কুণ্ঠিতস্বরে বলিলেন, ‘আপনারদের মতো লোক যে গরিবের বাড়ি এসেছেন, এই আমার পরম সৌভাগ্য। জাহাঙ্গীর বাবাজি না এলে তো আপনার পদার্পণ হত না এ অজ-পাড়াগাঁয়ে। – আর আপনাকে ভিক্ষা দেওয়ার মতো কোনো কিছুই নেই আমার।’

জাহাঙ্গীরের মাতা বলিলেন, ‘আপনার যে সন্তান-রত্ন আছে – তারাই যে সাত রাজার ধন। আমি হারুণকে ভিক্ষা চাচ্ছি। সে আমার নতুন জমিদারি স্টেটের ম্যানেজার হবে। আপাতত সে মাসে তিনশো টাকা করে পাবে। আমার একটি মাত্র ছেলে, কিন্তু সে কিছু নেয়ও না, দেখেও না। সে এরই মধ্যে আধা-দরবেশ হয়ে গেছে। হারুণ কিন্তু আমার ছেলের মতোই থাকবে – আর তার সাথে সাথে আপনাদেরও কলকাতা যেতে হবে। হারুণের কাছেই আপনারা থাকবেন। হয়তো চিকিৎসা হলে ওর মাও ভালো হয়ে উঠতে পারে!’

হারুণের পিতা বহুক্ষণ কোনো কথা বলিতে পারিলেন না। তবে কি ভূণীকে পুত্রবধূ করিতে পারিবেন না বলিয়া তাঁহার এই জমিদারি চাল? ইহা কি তাহারই ক্ষতিপূরণ? তাঁহার আত্মসম্মানে আঘাত লাগিল। ক্ষুণ্ণস্বরে তিনি বলিলেন, ‘আপনার দয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ দিচ্ছি বেগম সাহেবা, কিন্তু হারুণের তিনশো টাকা মাইনে পাবার মতো তো গুণ বা কর্মক্ষমতা নাই। আপনিও আমার ছেলের বন্ধুর জননী কাজেই আত্মীয়াও বললে হয়। আমাদের খুবই অভাব, তবু মাফ করবেন – আপনার কাছ থেকে এ দান নিতে আমার হাত উঠবে না।’

দেওয়ান সাহেব বুঝিতে পারিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বেগম সাহেবাকে আত্মীয়ার মতোই বলছেন কেন খোন্দকার সাহেব, উনি তো আপনার বড়ো আত্মীয় হতে চলেছেন – দু দিন পরে বেয়ান হবেন – ওঁকে যদি এমন করে ফিরিয়ে দেন, আমরা সকলে বড়ো ব্যথা পাব। এখানে আজ সকালে গ্রামের লোকের মুখে শুনেছি আপনাদের বাড়িতে কোনো ভিখারি সোনা-রূপা না পেয়ে ফিরে যেত না। আমরাই কি তা হলে শুধুহাতে ফিরে যাব?’

হারুণের পিতা এইবার গলিয়া গিয়া বেদনার্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘সেদিন তো আমাদের নাই দেওয়ান সাহেব! এখন এক মুঠো চাউল দিতে পারিনে ভিখিরিকে। আমার ওয়ালেদ সাহেব পর্যন্ত সত্যই আমাদের বাড়ির এই রেওয়াজ ছিল। আমিও তা দেখেছি মাত্র, কিন্তু এ কমবখ্‌ত বাপ-দাদার সে ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে পারেনি!’

জাহাঙ্গীরের মাতা বলিয়া উঠিলেন, ‘হারুণ আর তহমিনাই তো আপনার সোনার চেয়েও অমূল্য রত্ন – আমরা ওই সোনাই তো চাচ্ছি!’

হারুণের পিতা বিচলিত হইয়া উঠিলেন, ‘আর আমায় লজ্জা দেবেন না, দোহাই! গোস্তাখীর যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন। আমি আপনাদের যে ধরনের ধনী মনে করেছিলুম – আপনারা তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাইরের ঐশ্বর্য আপনাদের অন্তরের ঐশ্বর্যকে দেখছি এতটুকু মলিন করতে পারেনি। ভিক্ষা ভিক্ষা বলবেন না, ওরা আজ থেকে আপনারই সন্তান হল। আমি তো থেকেও নাই। আমি অন্ধ হয়ে ওদের কোনো-কিছুই দেখতে পারিনে। বাপ অন্ধ, মা পাগল। ওদের তো বাপ-মা থেকেও নেই! এখন থেকে আপনারাই ওদের বাপ-মা হলেন। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারব।’ বলিতে বলিতে তাঁহার কণ্ঠ ভাঙিয়া আসিল, আর বলিতে পারিলেন না।

দেওয়ান সাহেব বলিলেন, ‘শুধু ওদের তো নিতে আসিনি, আপনাদের সকলকেই যে নিতে এসেছি। আপনার পৈতৃক ভিটে চিরদিনের জন্য ছেড়ে যেতে বলছিনে, কিছুদিন কলকাতা থেকে আপনাদের দুই জনারই চিকিৎসাপত্র করান – খোদা যদি ভালো করে তোলেন আপনারা আবার ফিরে আসবেন এই বাড়িতে!’

হারুণের পিতা আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, ‘ভূণীর শাদি কি তা হলে কলকাতাতেই সম্পন্ন করতে চান? কিন্তু, তা তো হতে পারে না সাহেব।’

অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল, বিবাহ গ্রামেই হইবে! কিন্তু কিছুদিনের জন্য সেটা স্থগিত রহিল। হারুণ ইতিমধ্যে তাহার এই পুরাতন বাড়ির সংস্কার করিবে। হারুণের পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত হারুণের পিতা হারুণের জমিদারি কার্যে সাহায্য করিবেন। কথা হইল, এখন গ্রামের কাহাকেও বিবাহ সম্বন্ধে কিছু বলা হইবে না। হারুণ জমিদারি স্টেটে চাকুরি লইয়া সপরিবার কিছুদিনের জন্য চলিয়া যাইতেছে – ইহাই সকলকে জানানো হইবে। ইহাও স্থির হইল, আর তিন দিনের মধ্যে সমস্ত ঠিকঠাক করিয়া যাত্রা করিতে হইবে।

হারুণের পিতা ভয় করিয়াছিলেন, ইহাতে হয়তো একমাত্র ভূণীরই আপত্তি হইবে। কারণ কাল পর্যন্ত সে নাগিনির মতো ফণা ধরিয়াছে। কিন্তু ভূণীকে সব কথা বলার পর সে যখন এতটুকুও আপত্তি উত্থাপন করিল না – তখন পিতা বিস্মিত হইয়া ইহার কারণ সন্ধান করিতে গিয়া মনে মনে হাসিলেন। ভাবিলেন ‘বেটির আমার বর চোখে ধরেছে কিনা, তাই আর কথাটি কইতে পারলে না!’

হারুণের মাতা কিন্তু জাগিয়া উঠিয়া হইচই করিয়া তুলিলেন। এইসব অজানা লোকজন দেখিয়া কখনও তিনি হাসিতে, কখনও বা তারস্বরে মিনাকে ডাকিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। মায়ের ডাকে জাহাঙ্গীর ভিতরে আসিতেই উন্মাদিনী ‘ওই আমার মিনা এসেছে, আয়, আয়, সাইকেল দেব’ বলিয়া জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কিছুতেই ছাড়িয়া দিতে চাহিলেন না। মাতার আদেশে জাহাঙ্গীর সেইখানে অপরাধীর মতো বসিয়া রহিল।

সে আর চোখ তুলিয়া কাহারও পানে চাহিতে পারিল না! সব চেয়ে মুশকিল হইল ভূণীর, সে বাহির হইতে পারে না, অথচ বাহির না হইলেও নয়।

লজ্জায় মাথা খাইয়া ভূণীকে দুই একবার বাহিরে আসিতে হইল। সে না আসিলে চলিবেই বা কী করিয়া? এত লোকের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তো তাহাকেই করিতে হইবে।

জাহাঙ্গীরের মাতা হারুণের মাতাকে অনেক বুঝাইয়া জাহাঙ্গীরকে বাহিরে পাঠাইয়া দিয়া তহমিনাকে লইয়া পড়িলেন। রান্নার সমস্ত ব্যাপার তাঁহার বাঁদিদের হাতে তুলিয়া দিয়া তিনি ভূণীকে স্নান করাইয়া যখন হিরা-জহরত বসন-ভূষণে সাজাইয়া তুলিলেন, তখন গ্রামের মেয়েরাই বলিল, ভূণীর যে এত রূপ – তাহা তাহারাও জানিত না। অলংকার ও কাপড়-চোপড়ের বাহার দেখিয়া সকলেই বলিল, মেয়ে বরাত লইয়া আসিয়াছিল বটে! কেহ কেহ ইহাও বলিল যে, অত গহনা-কাপড় দিয়া সাজাইলে তাহার মেয়েকেও ইহার চেয়ে কম সুন্দর দেখাইত না।

মোমি ও মোবারক তাহাদের অদৃষ্টপূর্ব বসন-ভূষণে সজ্জিত হইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠিল। গ্রামের সমস্ত বাড়িতে সন্দেশ মিঠাই পরিবেশন করা হইল। সকলে এই সন্দেশ দেওয়ার অর্থ অন্যরূপ করিল। সন্দেশের মূলে যে ভূণী, ইহা লুকাইলেও কাহারও আর বুঝিতে বাকি থাকিল না।

দুই দিনেই দেওয়ান সাহেব ও জাহাঙ্গীরের মাতা গ্রামের প্রায় সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিলেন তাঁহাদের সহজ সরল নিরহংকার ব্যবহারে।

গ্রামের আত্মীয়স্বজনের নিকট অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় লইয়া হারুণেরা তাহাদের পৈতৃক ভিটার মায়া কাটাইয়া কলিকাতা যাত্রা করিল।

হারুণের নিকট-আত্মীয় একজন তাহাদের বাড়ি দেখাশুনা করিবেন কথা থাকিল। ইতিমধ্যে হারুণ আসিয়া নতুন করিয়া বাড়ি তৈরি করিয়া যাইবার পর তাহার পিতা-মাতা ফিরিয়া আসিবেন বলিয়া আত্মীয়স্বজনকে আশ্বাস দিল।…

হারুণের মাতা জাহাঙ্গীরকে দেখা অবধি আর বেশি কান্নাকাটি করেন নাই। তাঁহাকে বিশ্বাস করাইয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, তাঁহার মিনা বড়ো হইয়া বিদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। উন্মাদিনী তাহাই বিশ্বাস করিয়াছে। কাজেই তাঁহাকে লইয়া যাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।