[ ঝুড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ ] |
পথিক : |
মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? |
ঝুড়িওয়ালা : |
জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ ত জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি‒ |
পথিক : |
না না, আমি তা বলিনি‒ |
ঝুড়িওয়ালা : |
না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম‒ |
পথিক : |
না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒ |
ঝুড়িওয়ালা : |
চাচ্ছেন না ত ‘কোথায় পাব’ ‘কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম করবার মানে কি? |
পথিক : |
আপনি ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒ |
ঝুড়িওয়ালা : |
জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়‒ ‘জলপাই’ বলবার দরকার কি? জল আর জলপাই কি এক হল? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন? |
পথিক : |
ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে। |
ঝুড়িওয়ালা : |
অন্যায় তো হয়েছেই। দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি‒ তবে জলই বা চাচ্ছেন কেন? ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লোকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়। |
পথিক : |
দেখলে! কি কথায় কি বানিয়ে ফেললে! যাক, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি। |
[ লাঠি হাতে, চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ ] |
বৃদ্ধ : |
কে ও? গোপ্লা নাকি? |
পথিক : |
আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক‒ একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম‒ |
বৃদ্ধ : |
বল কিহে? পুবগাঁও ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতে? ‒ হাঃ, হাঃ, হাঃ। তা, যাই বল বাপু, অমন জল কিন্তু কোথাও পাবে না। খাসা জল, তোফা জল, চমৎকা-র-র জল। |
পথিক : |
আজ্ঞে হাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে। |
বৃদ্ধ : |
তা ত পাবেই। ভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায়। তেমন তেমন জাল ত খাওনি কখনো! – বলি ঘুম্ড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন? |
পথিক : |
আজ্ঞে না, তা খাইনি- |
বৃদ্ধ : |
খাওনি? অ্যাঃ! ঘুম্ড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি‒ আদত জলের জায়গা। সেখানকার যে জল, সে কি বলব তোমায়? কত জল খেলাম‒ কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল‒ কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম না। ঠিক যেন চিনির পানা, ঠিক যেন কেওড়া-দেওয়া সরবৎ! |
পথিক : |
তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন‒ আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে‒ |
বৃদ্ধ : |
তাহলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই ত পারতে? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কি ছিল? ‘যা হয় একটা হলেই হল’ ও আবার কি রকম কথা? আর অমন তচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কি? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না- বাস্। গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কি? আমি ওরকম ভালোবাসিনে। হ্যাঁঃ- |
[ রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থান ] |
[ পাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হসিমুখ বাহির করণ ] |
বৃদ্ধ : |
কি হে? এত তর্কাতর্কি কিসের? |
পথিক : |
আজ্ঞে না, তর্ক নয়। আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না- কেবলই সাত পাঁচ গপ্প করতে লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম ত রেগে মেগে অস্থির! |
বৃদ্ধ : |
আরে দূর দূর! তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি? ও হতভাগা জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি? ওর যে দাদা আছে, খালিপুরে চাকরি করে, সেটা ত একটা গাধা। ও মুখ্যুটা কি বললে তোমায়? |
পথিক : |
কি জানি মশাই- জলের কথা বলতেই কুয়োর জাল, নদীর জাল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, ব’লে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে- |
বৃদ্ধ : |
হুঁঃ ‒ ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। ভারি ত ফর্দ করেছেন। আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি পঁচিশটা বলে দেব- |
পথিক : |
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল‒ |
বৃদ্ধ : |
কি বলছ? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা শুনে যাও। বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিক জল, রোদে ঘেমে জ-ল, আহ্লাদে গলে জ‒ল, গায়ের রক্ত জ‒ল, বুঝিয়ে দিলে যেন জ-ল ‒ কটা হয় ? গোনোনি বুঝি ? |
পথিক : |
না মশাই, গুনিনি‒ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই‒ |
বৃদ্ধ : |
তোমার কাজ না থাকলেও আমাদের কাজ থাকতে পারে ত? যাও, যাও, মেলা বকিও না। ‒একেবারে অপদার্থের একশেষ! [ সশব্দে জানলা বন্ধ ] |
পথিক : |
নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না। |
[ লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ ] |
পথিক : |
লোকটা নেহাৎ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি। মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও? |
ছোকরা : |
কি বলছেন? ‘জল’ মিলবে না? খুব মিলবে । একশোবার মিলবে! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒ জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্ চল্ , আঁখিজল ছল্ছল্, নদীজল কল্কল্, হাসি শুনি খল্খল্, অ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল‒ কত চান? |
পথিক : |
এ দেখি আরেক পাগল! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি। |
ছোকরা : |
তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন‒ যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব। |
পথিক : |
ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) মশাই! আর কিছু চাইনে, ‒(আরো জোরে, শুধু একটু জল খেতে চাই! |
ছোকরা : |
ও বুঝেছি। শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই। এই ত ? আচ্ছা বেশ। এ আর মিলবে না কেন?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই ‒ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাই। চাই কিন্তু কোথা গেলে পাই‒বল্ শীঘ্র বল্ নারে ভাই। কেমন? ঠিক মিলেছে ত? |
পথিক : |
আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার । (সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে‒ একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা কনে নি । [একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল] |
ছোকরা : |
(খুশী হইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না? বলি, মেলাচ্ছে কে? সেবার যখন বিষ্টুদাদা ‘বৈকাল’ কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন ‘নৈপাল’ বলে দিয়েছিল কে? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত? নেপালের লোক হল নৈপাল। (পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায়? দুত্তোরি! [প্রস্থান] |